মেহেদী উল্লাহ’র গল্প

 মেহেদী উল্লাহ’র গল্প






বন্ধুর মায়ের জুতা জোড়া



জয়নগরে যাওয়ার দুটি কারণ। আমার এককালের বন্ধুর মাকে দেখতে যাওয়া, যে কালে ফেসবুক ফ্রেন্ড বলতে
কিছু ছিল না। বন্ধু আমার, ২০০২ সালে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়! আরেকটি হচ্ছে, জয়নগরে বিদ্যুৎ নাই। সর্বত্র
হারিকেন আর চাঁদ, অল্প এবং গভীর রাত্রিতে। আমি বন্ধুর বাড়ি পৌঁছলে বন্ধুর ছোট বোন আমাকে পিঁড়ি
দিল বসতে। বন্ধুর মা হারিকেনের আলোয় কোরান শরীফ পড়ছিলেন। এই ফাঁকে এদিক- ওদিক তাকিয়ে নিচ্ছিলাম। আর
হামদর্দের শরবত খাচ্ছি। শোকেসের উপর আরেকটা হারিকেন। হারিকেনের পাশে কোরান শরীফের খাপ দেখে বুঝলাম এখানে পবিত্র গ্রন্থটি থাকে। এর পাশেই 'খোয়াবনামা' রাখা। বন্ধুকে গিফট করেছিলাম সেসময়। বন্ধুর মা কোরান পড়া শেষ করে মেয়েকে ডেকে হাতে দিলেন শোকেসের উপর রাখতে। তিনি খাট থেকে নামলেন না। মেয়ে রাখল পবিত্র গ্রন্থটি। পড়তে পড়তে পুরনো হয়ে গেছে, অন্যদিকে খোয়াবনামা নতুন এখনো, বোঝা যায় কেউ ছুঁয়েও দেখে না। এবার আমি চমকে গেলাম। খাটের তলার বাইরে একজোড়া স্যান্ডেল। ডান পায়েরটি খুব পুরনো, একটা ফিতা ছেঁড়া। বাম পায়েরটি চকচকে নতুন। খেয়াল করলাম, বন্ধুর মায়ের বাম পা নেই, সম্ভবত হাঁটুর নিচ থেকে কাটা। তবুও কেন তাঁর বাম পায়ের স্যান্ডেল? সে কথা কী আর জিজ্ঞেস করা যায়?

ব্যবহার হোক বা না হোক কিছু জিনিস জোড়ায় জোড়ায়ই থাকে।






জেবুন্নেসার 'পানি পানি'



দুঃখজনক হলেও সত্য, জেবুন্নেসা বেগমের ছেলেরা তিনবারের সময় চরম বিরক্ত। শতবছরের নিকটবর্তী কমপ্লিটলি শয্যাশায়ী এই রোগীটির এর আগেও দুইবার জবান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ছেলেরা রুহের নিরাপদ যাত্রার জন্য দুইবারই কোরান খতমের আয়োজন করলেও মৃত্যুপথযাত্রী পরদিন ভোরের আগেই মৃত্যুকে জয় করে ফজরের নামায সফলভাবে আদায় করতে পেরেছিল।
তাই এইবার জবান বন্ধ হলেও আয়োজন নাই। উল্টো ছেলেরা নৈশকালীন কাজও খুঁজতেছে! যাতে কাজের জরুরতে তাদের সেবাবিহীন মায়ের মৃত্যুবিষয়ক অবহেলা নিজেরাও টের না পায়! তাই ছেলেরা কিংবা ছেলের বউদের না থাকার মধ্যেই জবান খোলার পর জেবুন্নেসা দেখে, শেষরাতে চাঁদ বড় হয়ে গেছে, খড়ের চালার ফুটো দিয়ে তা দেখে চরম পিপাসাযুক্ত হয়ে 'পানি, পানি' জবানে সে ছটফটানো অবস্থায় ফজর শেষ না করেই যাত্রা করলো। ইন্তেকালের আগে তার মনে হয়েছিল, এই সেই চাঁদ যা সে ১৯৮৮ তে দেখেছিল!

মা চলে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেরা দেখল, গ্রামের সবচেয়ে পুরনো কবরটায় বাচ্চারা মাছ ধরছে, যেটা অনেক উঁচুতে। রাস্তাগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।চাপকল থেকে পানি নেওয়া যাচ্ছে না।
চারিদিকে জেবুন্নেসার 'পানি পানি'। ১৯৯৮!






দুখু মিয়ার গরুরা, ভাতের কষ্ট ও যাত্রাপালা


অবচেতনে তাঁকে কৃষ্ণের সাথে মিলাতেই বোধ হয় তাঁরা গরুকে ফোকাস করেন!
আমি সময় পেলেই ত্রিশালের মুরব্বিদের কাছে নজরুলের ছেলেবেলার ঘটনা শুনতে চাই; যে এক-দেড় বছর এখানে ছিলেন তার ওপর ভিত্তি করে! তাঁদের বেশিরভাগই একটি ঘটনা বেশি বলে। সেদিনও এক মুরব্বি বলছিলেন ঘটনাটি।
ঘটনাটি এরকম। এখানে দুখু মিয়া যে বাড়িতে থাকতেন তাঁরা পছন্দ করতেন না তিনি রাতে যাত্রাপালা দেখেন। সেটা দুই কারণে হতে পারে। দুখু মিয়ার বয়স কম আর দৃষ্টিভঙ্গিগত জায়গা থেকে যাত্রাবিরোধী।
কিন্তু দুখুর তো দেখতেই হবে। তাই সন্ধ্যায় লুকিয়ে চলে গেলেন দূরের গ্রামে যাত্রা দেখতে। তারপর মনের সুখে দেখেটেখে ফিরলেন রাত তিনটা-চারটার দিকে।
বাড়ির উঠানে পা রাখার পর জোরে চিৎকার করে উঠলেন, চোর চোর বলে। বলতে থাকলেন, চোর গরু নিয়ে যাচ্ছে। শুনেই বাড়ির লোকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তারা বেরিয়ে কোনোরকম গরুগুলোকে ধরলেন, কিন্তু চোর পালিয়েছে।
ঘরের কর্তা দুখুর ওপর খুশি হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন,' ক্ষুধা লাগে না তোর! যা ভাত খা গিয়া।'
কোথায় ছিলেন কিছুই জানতে চাইলেন না। এই যাত্রায় বাঁচা গেল!
মুরব্বি এবার হেসে উঠলেন। তারপর বললেন,' নজরুলের অনেক বুদ্ধি। তিনি ক্ষুধার চোটে নিজেই গরু ছেড়ে দিছিলেন। এই উছিলায় এতরাতে ঘরেও ঢোকা হল, ভাতও খাওয়া হল।'
এবার মুরব্বি গরুকে ফোকাসে রেখে অন্যদের মতো বললেন,' দেখছেন! গরু নিয়া নজরুলের কী সুন্দর ঘটনা!’

আমি উত্তর দিলাম, 'হ্যাঁ, কবি জীবনে এই গরুদের অনেক অবদান। তাইতো তাঁর যাত্রাভঙ্গ হয়নি।'







অর্ধচন্দ্র 



তাহাদের বাসার ছাদে আমরা গল্প করছিলাম, গল্পের উত্তর-প্রতিউত্তরের মধ্যে কেটে গেল পিচ্ছিল গোধূলিটি। তাহারা বলতে দুই বোন।

প্রসঙ্গক্রমে বড় বোনটি দোতলার বাসায় চা আনতে গেলে ছোট বোনটিকে আমরা জিজ্ঞেস করি, 'তোমার দিদিকে ছাড়া থাকবা কেমনে, বিয়ের পর।'
সে উত্তর দেয়, 'এই বাসা ছাড়া আমাদের ভালো লাগে না। দিদিকে কোথাও যেতে দিব না। দিদি এ বাসাতেই থাকবে।' আমরা অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, তুমিও বিয়ে করবে না?
সে বলল, 'এ বাসা ছাড়া আমি একদিনের জন্যও কোথাও থাকতে পারি না।

বুঝলাম, তাহারা পিঠাপিঠি, এখনও পর্যন্ত না ছাড়াছাড়ি সম্পর্কিত  পরিমণ্ডলের বোধ-বুদ্ধি নিয়েই বড় হইতেছে। তবে জগতের কোনো সম্ভাবনাই যেহেতু উড়িয়ে দেবার মতো নয়, তাই দুই বোনের এই সংসার নাও ভাঙতে পারে। আপাতত তাদের ভাই নাই, বাবা- মা আছে।

আকাশে যিলহজ মাসের ছয় কি সাততম দিনের চাঁদ। তাকে দেখিয়ে আমরা বললাম, 'দেখো, চাঁদ।'
সে বলল, 'কী সুন্দর চাঁদ পরিষ্কার আকাশে!'
এবার আমি বললাম, 'হয়তো তোমার ভবিষ্যতের দিদিটি।'
শুনে সে চাঁদটিকে ভালো করে দেখতে থাকে।






সর্পবংশ



মালতী যে সর্পবংশের মেয়ে আজ বিশ্বাস হলো মোস্তফার। বিয়ের আগে অনেকেই নিষেধ করে তাকে বলেছিল,'করিস না বিয়া। দেখস না, ওর চেহারার সাথে সাপের চেহারার মিল আছে।'

মোস্তফা মালতীর জন্মের কাহিনিটা জানে। এক ভোররাতে মালতী আর ওর বোন না যেন ভাইয়ের জন্ম। গৃহস্থের গোলাঘরে মালতীর মা মালতীর সঙ্গে একটা সাপেরও নাকি জন্ম দিয়েছিল। ভয়ে সবাই বাচ্চা সাপটাকে তাড়িয়ে দিয়ে মালতীকেই শুধু তার মায়ের কোলে তুলে দিয়েছিল। সেই থেকে মালতী তার সাপ ভাই কিংবা বোনের ঈর্ষার পাত্র।

এই গালগল্প পাত্তা না দিয়েই আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে মালতীকে বিবাহ করেছিল মোস্তফা। 

আজ সকালে মালতীর বড় ছেলেটাকে হঠাৎ সাপে কাটে। মালতীকে খবরটা দেয় তার মেঝ ছেলে ও ছোট মেয়েটা। শুনে মালতী আশপাশে কাউকে না পেয়ে ছুটে যায় ওঝা ডাকতে। ফিরে এসে দেখে বাকি দুই সন্তানও পানিতে ডুবে মারা গেছে। 

খবর পেয়ে সাথে সাথেই মোস্তফা বাড়ি ফেরে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে। এসে দেখে মানুষের ভীড়। তার মধ্যেই বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মালতীর মাথা, ঘাড় ও লেজে সমানে বাড়ি দিতে থাকে। আর বলে, 'তুই কই থাকস?'

মালতী মাটিতে পড়ে মোড়াতে থাকে, তারপর মারা যায়। তার ঘাড় ও লেজ থেতলে গেছে, কোমর ভাঙা।

সাপের বংশ সব মাত্র একদিনেই নির্বংশ হলো।
ঈর্ষা!  






Post a Comment

Previous Post Next Post