লেখক হয়ে ওঠায় শিল্পমান বেশি জরুরী/ কবি ও লেখক: বঙ্গ রাখাল/ সঞ্চালক- সাগর ইসলাম / হরকরা প্রকাশন

 


সাক্ষাতকার পর্ব: ০৭ 
আলোচক অতিথি: কবি ও লেখক বঙ্গ রাখাল







সাগর ইসলাম:  কবি কেমন আছেন? কোনো ফরমালিটি দিয়ে শুরু না করে চাচ্ছি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে। প্রথমেই জানতে চাচ্ছি আপনার মুক্তচিন্তা ও গবেষণামূলক সাহিত্য সম্পর্কে। এ বিষয়ে যদি বিস্তারিত বলতেন।


বঙ্গ রাখাল: এই তো বেশ আছি। তবে বুঝতেই পারছেন-চারিদিতে এতো এতো আহাজারি, মানুষের আত্মচিৎকার, সর্বস্ব হারোনো মানুষের যন্ত্রণার সংবাদ শুনতে কিংবা দেখতে দেখতে আমরা মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি। এমতাবস্থ্য়া কী করে ভালো থাকা যায় বলেন তো কবি? আসলে আমার মুক্তচিন্তা ও গবেষণার কথা বলতে হলে-শুরু করতে হবে আমার বাল্যকাল থেকে। ছোটবেলায় আমার মা- মাজেদা বেগম; তার কাছে বসিয়ে আমাকে বর্ণমালা শেখাতেন, আঁকি-উকি দিলে খুব উৎসাহ দিতেন। তিনি খুব নিপুণ হস্তে নকশিকাঁথা সেলাই করতেন। তার কাছে থাকতো দুই ব্যাটারীর রেডিও; তিনি আব্দুল আলীম, আব্বাস উদদীন, নীনা হামিদের গান খুব পছন্দ করতেন এবং শুনতেন-তিনি নিজেও অনেক গজল পারতেন। সেই দিনের কথা মনে পড়লে আজও নিজের মধ্যে একধরনের বিদ্যৎ শিহরিত হয়। আর বাবা সে তো আমার আরেক প্রেরণার নাম। বাবা আমাকে কোথাও গাজির গান কিংবা বায়োস্কোপ হলে সাথে করে নিয়ে যেতেন। আসরের সামনে আমাকে বসিয়ে তিনি নিজের মত বেড়াতেন। আমি বাবার দেওয়া শালের চাদর মুড়ি দিয়ে সারারাত গান শুনে ফজরের আজানের সময় বাড়িতে ফিরতাম। আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামে অর্থ্যাৎ চর-চড়িয়া লালনের আখড়া আছে-যে আখড়াটা লালন তাঁর প্রিয় শিষ্য শুকুর শাহকে দান করে দিয়ে আসেন এবং তিনি কয়েকবার এখানে এসে বাহাচও করেছেন-যার প্রমাণও পাওয়া যায়। আবার পাশেই রয়েছে ফুলহরি গ্রাম। যেখানে ঝিনাইদহের সবচেয়ে বড় প্রতীমা ওঠে। এক সময় আমাদের গ্রাম-গোলকনগরে অষ্টগান, গাজীরগান ও যাত্রাপালা হত। এই যে পরিবেশ; এই পরিবেশই আমাকে একজন মুক্তমনা এবং একজন গবেষক হতে সাহায্য করেছে। আমার প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধের বই- সংস্কৃতির দিকে ফেরা’। যে বইয়ের সব প্রবন্ধই এই শিকড়ের বিষয় নিয়ে লিখিত হয়েছে। পরে কাজ করেছি- লালন, পাগলা কানাই, বিজয় সরকাল, শ্রীকান্ত ক্ষ্যাপা, পাঞ্জু শাহ, দারোগ আলী বয়াতী, লোক কবি হাসানুজ্জামান, কবি আকছারুল ইসলাম ও সাইদুর রহমান বয়াতীকে নিয়ে। ‘বলাকা’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘মানবতাবাদী লালন জীবন অন্বেষণ’, অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে-‘পাগলা কানাই ও তাঁর তত্ত্বদর্শন।’ গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও গবেষণার কাজ করেছি। ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার ছোটবোয়ালিয়া-জয়ন্তীনগর ও বসন্তপুর গণহত্যা’ নামেও একটা গবেষণামূলক বই গণহত্যা জাদুঘর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণা কাজকে আরও একটু একাডেমিকভাবে করার জন্য ভর্তি হয়েছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগে। সেখানে এমফিল করছি ‘বাংলাদেশের হাটুরে কবিতা’র উপর। এটাও সাহিত্যের একটা অসাধারণ শাখা। যা আমাকে সত্যিকার অর্থেই কাজ করতে আগ্রহী করে তুলেছে। এটা নিয়ে হয়তো কাজ করা হত না- আমার শিক্ষক; কবি ও কথাসাহিত্যিক মোস্তফা তারিকুল আহসান স্যার যদি এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করার আগ্রহ আমার মধ্যে সৃষ্টি করতে পারতেন? স্যারের কাজ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েই এই কাজটি করার জন্য প্রাণিত হয়ে উঠি। কাজ করছি ‘গরীবের ডাক্তার’ খ্যাত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে। অচীরেই আমার সম্পাদনায় তাকে নিয়ে বিশাল কলেবরে একটা গ্রন্থপ্রকাশিত হবে। এভাবে কাজ করে যাচ্ছি-কাজ করতে ভাল লাগে।



সাগর ইসলাম: আপনি কতো বছর যাবৎ বাংলা সাহিত্যের সাথে আছেন? কবিতা পাশাপাশি আপনি কি গবেষণামূলক কোন কাজ করছেন বা সাহিত্যের অন্যান্য শাখা নিয়ে কাজ করছেন? আপনি কি একজন লেখক পাশাপাশি মানুষ জীবন লিড করছেন নাকি মানুষ জীবনের পাশাপাশি লেখক জীবন লিড করছেন?


বঙ্গ রাখাল: পূর্বেই বলেছি আমি আমার বাল্যকাল থেকেই এই সাহিত্যের আবহের মধ্যে বড় হয়েছি। এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলই আমাকে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হতে সাহায্য করেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে আমি সব সময়ই এই সাহিত্যের মধ্যেই আছি। কবিতা লেখি-কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ-গল্প ও নাটকও লিখেছি। করেছি গবেষণা এবং এখন তা একাডেমিভাবেও করছি। আমি মূলত লেখক জীবনের পাশাপাশি মানুষ জীবন লিড করছি। আমি সর্বদা একজন লেখকের জীবন-যাপন করতে চেয়েছি এবং তা করছিও বটে। আমি কোন দাম্ভিক্যতাকে পছন্দ করি না। আমি কোন অ্যান্ড্রোয়েট ফোন ব্যবহার করতাম না। পরে চাকুরীর কারণে এবং নিজের কাজের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে একটা ফোন নিয়েছি। আমি তো লেখকের জীবনকেই নিজের মধ্যে ধারণ করতে চেয়েছি। আমার মধ্যে কখনোও কোন হাম্বরাভাব আসেনি। নিজে ভাল ভাল পোষাক-আশাকের চেয়ে একটা বই কেনাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছি। অনেক নজির আছে খাওয়ার টাকা নেই অথচ বই কিনে এনে পড়েছি। আমাকে অহংকার করে চলতে হবে এমনটি কখনো ভাবিনি- আমি চলতে চেয়েছি একজন সাধারণ মানুষ হয়ে। যেন আমার প্রতিভার কথাও কেও না জানে জানলে অনেকে আমার সাথে মিশতে চাইবে না। বা আমাকে আলাদা মানুষ ভেবে আমার থেকে দূরে থাকবে- যে কারণে এক সময় আমি নিজের সৃজনশীলতার পরিচয়ও দিলাম না। এখন অবশ্য দেই। তাই আমার প্রতিটা কাজের মধ্যেই থাকে সাহিত্য। আমি সাহিত্য ছাড়া অন্যকিছু তো করতেও পারি না। এই কাজ করতে গিয়ে নিজের পরিবারকেও বঞ্চিত করেছি। নিজের জন্য দু মিনিট সময় ব্যয় করিনি। তো ভেবে দেখেন আমি মানুষ জীবন যাপন করছি নাকি লেখকজীবন যাপন করছি?


সাগর ইসলাম: বর্তমান কবিরা একজন আরেকজনের মতবাদ নিয়ে নানারকম আলোচনা / সমালোচনায় ব্যস্ত। কখনো কখনো বা বেশির ভাগই দেখা যায় তারা সবসময়ই তাদের সৃষ্টি অর্থাৎ কবিতা বা বই নিয়ে আলোচনা/ সমালোচনা না করে ব্যক্তি আক্রমনই বেশি করেন, মূল যে বিষয়ে আলোচনা/সমালোচনা হওয়া দরকার তা না হয়ে হয়ে যায় ব্যক্তিগত বা দলগত আক্রমন- এসব বিষয় আপনি কীভাবে দেখেন এবং আপনার এসব বিষয়ে মতামত কি?


বঙ্গ রাখাল:  সাগর, আমি নিজেও একজন কবি। আপনি যে বিষয়টা আমার কাছে জানতে চাইলেন আমিও এই বিষয়টা  অনুভব করি। সমাজে শুধু এই অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়েই আলোচনা বা সমালোচনা হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা মূল বিষয় নিয়ে আলোচনা করি না। এই নোংরাচর্চা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে না পারলে ভাল কিছু করা সম্ভব না। আবার এই নোংরামী যে এখনই হচ্ছে তা নয়। আদিমযুগ থেকেই চলে আসছে। লালন, রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের সাহিত্য নিয়ে আমরা কথা না বলে বারংবার তারা হিন্দু না মুসলমান এমন নানা অবাঞ্চিত প্রশ্নগুলো করে থাকি-কিন্তু তাঁদের সাহিত্য নিয়ে সাহিত্যিক বিবেচনায় কাজ করি না। আমরা তাদের ধর্ম বা ব্যক্তি মানুষের নানা ফিরিস্তি করে থাকি। তাহলে কি এটা এই সমাজেই প্রচলিত; না পূর্ব থেকেই এই ধারা চলমান। তবে এই ধারা আমাদের পরিত্যাগ করা উচিত। আমরা সাহিত্য নিয়ে কথা বলব, সমালোচনা করা কিন্তু সেটা হতে হবে গঠনমূলক। যেন এটা ব্যক্তিগত রোষের সৃষ্টি না করে।



সাগর ইসলাম: সাহিত্যের উত্তরাধুনিকতা বলতে বর্তমানে আপনি কীভাবে দেখেন। আপনার দৃষ্টিতে বর্তমান সাহিত্য কি আদতেই উত্তরাধুনিকতায় পৌঁছেছে?


বঙ্গ রাখাল: আসলে একটা যুগের পরিবর্তনের পরে আরেকটা যুগের আগমন ঘটে। আমরা আধুনিকতার পরবর্তী যুগকে উত্তরাধুনিকতা বলছি। এটা তো হতেই পারে। আসলে আপনার কাছে আমার বলতে হচ্ছে আমরা আধুনিকতা বলতে কি বুঝি? আমরা কি আধুনিকতাকে অতিক্রম করতে পেরেছি? এটার পরে না উত্তরাধুনিকতা আসবে। আর উত্তরাধুনিকতা বলতে আমরা যে সব সীমা-পরিসীমা মানদণ্ডে পরিগণিত করছি। তা হলে তো আমাদের অনেক সাহিত্যিকেরা এই যুগে পৌঁছে গেছে। কি আমাদের কবি সৈয়দ শামসুল হক কোন এক লেখায় বলেছিলেন- আমরা তো এখনো প্রকৃতপক্ষে আধুনিকতাকেই স্পর্শ করতে পারেনি উত্তরাধুনিক তো দূরের ব্যাপার। এ থেকে আপনি তো পরিস্কারভাবেই বুঝতে পারছেন আমরা আধুনিকতায় আছি; না উত্তরাধুনিকতায় কবিতার চর্চা করছি।


সাগর ইসলাম: লেখক হয়ে ওঠায় শিল্পমান বেশি জরুরী নাকি লেখাই বেশি জরুরী?


বঙ্গ রাখাল: আমার কাছে লেখার চেয়ে শিল্পমান সম্পন্ন লেখা বেশি জরুরী। অনেকে হাজার হাজার লিখেছেন কিন্তু সেটার শিল্পমান সম্পন্ন না-তাহলে সেটাকে কি করে আপনি শিল্প বলবেন। শিল্প হতে হলে অবশ্যই আপনার লেখা শিল্পমান সম্পন্ন হতে হবে। কাসেম বিন আবু বকরও তো প্রচুর গ্রন্থের প্রণেতা। একসময় এদেশে তারও প্রচুর পাঠক প্রিয়তা ছিল কিন্তু সেটা শিল্পমানের অভাবে শিল্প হয়ে উঠেনি। অন্যদিকে কুসুম কুমারী দাশ র্অপ লিখেও শিল্পমানের কারণে তা শিল্প হয়ে উঠেছে।


 


সাগর ইসলাম: লোকসাহিত্যের প্রভাব বাংলা সাহিত্যে দিন দিন কমে যাচ্ছে, এর কারণ আপনি কি  দেবেন, শিক্ষা ব্যবস্থার অনুপস্থিতি নাকি বাংলা একাডেমিরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করার দুর্বলতা।


বঙ্গ রাখাল: লোকসাহিত্য তো আমাদের শিকড়-আমাদের অস্তিত্বে নাম। লোকসাহিত্যের একটা সমৃদ্ধ বিভাগ রয়েছে বাংলা একাডেমিতে। সেটা থেকে ধারাবাহিকভাবে একসময় বিভিন্ন মহাজনদের নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলা একাডেমি ফোকলোর সংকলন। প্রকাশিত হয়েছে ৬৪ জেলার লোকসাহিত্য নিয়ে ৬৪টা গ্রন্থ। আবার আমাদের দেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়-এই তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে ফোকলোর বিভাগ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল লোকসাহিত্যের প্রতি সেই আগ্রহ এখনো আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি- যা গবেষণা করা হয়েছে পদ-পদবীর জন্য করা হয়েছে। হৃদয়ে ধারণ করে কেউ নির্লোভ ভাবে কোন কাজ করতে চাই না। যে কারণে আজ বিভাগের নাম পরিবর্তন করার জন্য আন্দোলন করতে হয়। আমরা সেই সব মানুষকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারিনি যারা আমাদের এই লোকসাহিত্যকে অন্তরে ধারণ করে তাদের জীবনটাকে এই পথেই ব্যয় করেছেন। তাদের জীবিত থাকা অবস্থায় আমরা তাদের কাছ থেকে এই সব লোকসাহিত্যের অমূল্য উপাদানগুলো সংগ্রহ করিনি বা সংগ্রহ করলেও সেটা আর কখনো আলোর মুখ দেখেনি। তাদের মৃত্যু মানে লোকসাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার শেষ। আবার যারা জীবিত আছেন তাদেরও আমরা মূল্যায়ন করি না। এভাবেই অনেক উপাদান হারাতে বসেছে। লোককবিদের আজও সমাজেও অনেক অবহেলা সহ্য করতে হয়। কর্মের ক্ষেত্রেও সেই জায়গা আজও তৈরি করা সম্ভব হয়নি-যে কারণে এই বিষয়ে পড়ালেখা করতেও কেউ আগ্রহ পাই না। পড়তে হয় তাই বাধ্য হয়ে পড়ে। এই সাবজেক্টের গুরুত্ব আমরা সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি বরং বারে বারে এই ফোকলোর সম্পর্কে অনিহা পোষণ করেছি এবং গান নৃত্যের বিষয় হিসেবে আমরা মনে করেছি। নিজের অর্জিন সম্পর্কে আমরা জানতে বা জানাতে ব্যর্থ। আধুনিক যুগে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির প্রভাবে লোকসাহিত্যের অনেক উপাদার আজ বিলুপ্ত প্রায়। কিন্তু আমাদের কালের সাক্ষী-ইতিহাসের দলিল এই সব লোকসাহিত্য; যা আমাদের অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। লোকসাহিত্যকে অস্বীকার করা মানে নিজেকেই অস্বীকার করা।





 

Post a Comment

Previous Post Next Post