শ্মশান ঠাকুরের “হাহাকারের হাসি” জুয়েল কলিন্দ’র পাঠ প্রতিক্রিয়া

 শ্মশান ঠাকুরের “হাহাকারের হাসি” জুয়েল কলিন্দ’র পাঠ প্রতিক্রিয়া



হাহাকারের হাসি
বইয়ের ধরনঃ কাব্যগ্রন্থ
প্রথম প্রকাশঃ আগস্ট- ২০১৭
প্রকাশনিঃ অদ্বৈত প্রকাশনী
প্রকাশকঃ বখতিয়ার সুমন
প্রচ্ছদঃ মুহাম্মদ শফিউল ফারুক
মুল্যঃ গায়ের মূল্য- ২২৫ টাকা।
“কবিতা লিখি না আমি সারিবদ্ধ আর্তনাদ গাথি”
কবি শ্মশান ঠাকুরের “হাহাকারের হাসি” কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ পাতায় কবির এই স্বীকারোক্তি দেখতে পাই। উৎসর্গ পাতায় কবি আরও বলেন-
“প্রতিদিন আধুনিক হয় আঘাতের অস্ত্র”
সতিই এমন একটি লাইন পড়ার পর যে কোন সুস্থ বোধের মানুষ এই অস্থির সময়, সমাজ আর রাষ্ট্র কাঠামোয় টের পান আমাদেরই রক্ত, মাংস আর ঘামের বিনিময়ে আমাদের আঘাত করার অস্ত্রগুলোই প্রতিদিন আধুনিক করে গোড়ে তুলছে তথাকথিত সভ্যতা।
এরপরই কবি বলছেন-
“তবু ক্ষত প্রকাশের সুর ভালবাসার দায় নেয় না”
আর নেয় না বলেই পৃথিবীর মানুষের রক্ত, মাংস আর ঘামের বিনিময়ে সেই মানুষকেই আঘাত করার অস্ত্র প্রতিদিন আধুনিক হয়ে ওঠে। যন্ত্রণাগুলো শুধু গ্রন্থিতই থেকে যায়।
কবি “অনন্ত জাহিদ” কবি “সাইফুজ্জামান সোহাগ” কবি “অভিজিৎ দাস” এই তিন সহযোদ্ধার নামে “হাহাকারের হাসি”র তরঙ্গধ্বনি উৎসর্গ করেছেন কবি শ্মশান ঠাকুর। পাতা উল্টে ঢুকে পড়ি ভিতরে মূল কবিতায়। দেখি দুই, চার কিংবা পাঁচ লাইনের ছোট ছোট কবিতা কিন্তু একেকটি কবিতা যেন একেকটি আস্ত নক্ষত্র কিংবা কৃষ্ণগহ্বর। এত অল্প কথায় কবি এত বিষদ বিষয়ের তথ্য দিচ্ছেন অথচ ভাষাগত যায়গা কত সহজ, সাবলিল। কত সহজেই বুঝে ফেলা যাচ্ছে অথচ এই কাব্যগ্রন্থটি না পড়লে যেন বোঝাই হতো না যে, এত বিষদ বিষয়ও এত সহজে এবং এত অল্প কথায় বলে দেয়া যায়। তবে শেষের দিকে কিছু দীর্ঘ কবিতা আছে তবু এক পৃষ্ঠার বড় নয়। মূলত যা বলার বা প্রকাশের তা অহেতুক না পেঁচিয়ে যত সুন্দর করে অল্প কথায় প্রকাশ করা যায় এই যেন কবি শ্মশান ঠাকুরের উদ্যেশ্য এবং লেখার বৈশিষ্ট। আমার তাই মনে হয়েছে পাঠ শেষে।
“ঈশ্বর আমায় শুয়ো পোকা করেছিলেন
কিন্তু
তোমার ঘরে প্রজাপতি হয়ে গিয়েছিলাম।''
কবি যেন বলতে চাইছেন জন্ম কাল, স্থান কিংবা পরিবেশের উপর কিছুই নির্ভর করে না। সত্য দিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ ও সুন্দর করে তোলাই মানুষের ধর্ম হওয়া উচিৎ। সত্যের জন্য কবি লড়াই করে যেতে চান আমৃত্যু। এমনকি দাফনের সময় দেখে নিতে বলেন, তার অহংকারী লড়াইয়ের চিহ্নগুলো। তিনি খুন হলে মৃতদেহ টুকরো করে ছড়িয়ে দিতে বলেন ফসলের মাঠে। কেঁচো মাতৃগর্ভে অপেক্ষা করে ফসলের পরবর্তী প্রজন্মের আহারের ধাতু হয়েও কবি আবার ফিরে আসতে চান লড়াইয়ের ময়দানে। কারন, লড়াই ব্যতিত সত্য প্রতিষ্ঠার আর কোন উপায় নেই।
কবি হাঁটু গেড়ে ক্ষমা নয় শাস্তি প্রার্থনা করেন অতঃপর পথ চলেন ঈশ্বরের ঠিকানার খোঁজে। কারন, তিনি বলেন-
“মানুষই একমাত্র ঈশ্বরের ঠিকানা জানে”
কিন্তু সেই ঠিকানা খুজে পেতে প্রয়োজন হয় গভীর আত্ম উপলব্ধি আর সাধনার। কবি বলছেন-
“আমি এক ছায়া মাত্র তুমি আলকিত হলেই চলে যাব''
মানুষকে সত্যের স্পর্শে আলোকিত করার জন্য কবির এই আত্মত্যাগ। তার আগ পর্যন্ত তিনি ছায়ার মতই মানুষের সাথে থাকতে চান। এ তো মানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই মানুষের দায়। প্রতিটা মানুষেরই আছে এই দায়।
“প্রেম এক ইবাদত
ঈশ্বর যেখানে পূর্ণাঙ্গতা পায়।''
আমাদের বোঝার আছে এ কোন প্রেম? একি শুধুই নর-নারীর দেহবৃত্তির প্রেম? নাকি ঈশ্বর আর প্রকৃতির সাথে মানুষের প্রেম। যে প্রেমের জন্য প্রয়োজন গভীর সাধনার। আর সে প্রেম তো অবশ্যই ইবাদতের শামিল।
“স্বর্গ এবং নরক বুঝতে পারি না
তবে পৃথিবী পুলসেরাত।''
হ্যাঁ এই পৃথিবীই মানুষের কর্মক্ষেত্র আর এই পৃথিবীকেই সত্য দিয়ে সুন্দর করে তোলাই মানুষের দায়, ধর্ম। তীব্র আকাঙ্খায় কবি প্রশ্ন রেখেছেন তারই স্বজাতি বন্ধুর কাছে-
“কেন বন্ধু?
তোমার চিন্তায় লালা লাগায় ভিনদেশি দার্শনিক বাদুর?”
আমরা সহজেই বুঝতে পারি কবির এই হাহাকারময় প্রশ্নের কারন। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পি সহ কত শত বুদ্ধিজীবীরা প্রতিদিন খ্যাতি আর অর্থের লোভে ভিনদেশীদের কাছে আদর্শ বিকিয়ে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। কবি বলছেন-
“ভাঙ্গো
যদি আমাকে ভেঙ্গে তোমাকে গড়তে পার।''
তারপরও কবির একান্ত কামনা মানুষ নিজেকে মানুষ করে গোড়ে তুলুক। মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক।
“নির্বোধ পিতামহ! অপরাধকে উন্মুক্ত রেখে ঘরকে কারাগার বানিয়েছেন; মুক্তি আর সত্য চর্চার জন্য।''
আমাদের সকল পিতামহেরাই তাই করাছেন। আমরাও নির্বোধের মত তাই করে যাচ্ছি। কি লাভ? অপরাধকে দমন না করে, বহির্জগতে অপরাধকে উন্মুক্ত করে রেখ্‌ ঘরে বসে মুক্তি আর সত্যের চর্চা করে? তার ফলাফল কি পুথিগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধনের মতোই নয়?
নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থেকেই জন্ম নেয় কবির আরেকটি নতুন ক্ষমতার। তিনি বলেন-
“নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানই একটি নতুন ক্ষমতার জন্ম দেয়।“
সকল যুবকদের আহ্বান করে কবি বলছেন-
“যুবক!
যখন জননী অরক্ষিত তখন প্রেমিকা নিরাপদ নয়।''
আজকের যুবকদের এ সত্য বোঝা খুব দরকার। না বুঝলে আর উপায় নেই। যেখানে জননী, মাতৃভূমি অরক্ষিত, সেখানে প্রেমিকার নিরাপত্তা কোথায়? মুলত বর্তমানে আমরা সকলেই এই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি প্রতিনিয়ত। আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যুবক আর তরুণদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।
কবি প্রচণ্ড মানসিক হাহাকার নিয়ে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে বলেন-
"বড় অসময়ে জন্মে গেছি প্রিয়তমা
উপহারে ফুলের বদলে হাতে তুলে দেই
আত্মরক্ষার তরবারি"
হ্যাঁ আমাদের জান, মাল এমনকি স্বাভাবিক জিবিন যাপন আজ হুমকির মুখে এবং অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, আমদের নেই স্বাধীন কোন মত প্রকাশের অধিকার এমনকি সাধারণ মানুষের আত্মরক্ষার সামান্য পদক্ষেপকেও রাষ্ট্রপক্ষ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে প্রকাশ করছে।
“হাহাকারের হাসি” কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা যেন আগুন ঝরা নক্ষত্র। সুপ্ত বোধের উপর তীক্ষ্ণ আঘাতে জাগিয়ে তোলে চেতনা। চাক্ষুষ পার্থক্য বুঝিয়ে দেয় সত্য মিথ্যার। খুলে দেয় দিব্য অন্তর্দৃষ্টি। 
 

ধন্যবাদান্তেঃ
জুয়েল কলিন্দ
 সম্পাদক


Post a Comment

Previous Post Next Post