মাসুদ খানের কবিতা
ধীবর
তুমি তো ধীবর জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে
জাল ফেলে নিশ্চুপ। এই ধৈর্যের রূপ
এমন জাদুর জালে কত মাছে, শৈবালে
ছুটে এসে দেয় আত্মাহুতি।
তুমি জাত-জলদাস, তবু এ কী পরিহাস
মাছে দেখি জাগে অনুভূতি!
ধীবরের শাদা মন, সদা ভাবছ কখন
নদী জাগে মাছের জোয়ারে!
তুমি তো ধীবর জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে।
জল ও জালের লীলা, তরলে ভাসায় শিলা
ঘাই মারে মৎস্যরতন
জাল নয়, কালাচাঁদ, মায়া লাগানোর ফাঁদ,
ত্রিভুবনে কী আছে অমন?
জালের মায়ায় ম’জে, সাধু ধীবরের খোঁজে
ধেয়ে আসে আধেয়, আধারে।
তুমি তো ধীবর জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে।
একে তো ঘোলাটে পানি, তদুপরি কানাকানি,
জলে নাকি কামট, কুমির
তবুও ধীবর বলে, কখন নামব জলে
মনপ্রাণ উতলা, অধীর।
মন তবু মানে তার, প্রাণটা তো অনিবার
ছুটে যায় ইশারা আকারে
তুমি তো ধীবর জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে।
এমন নদীর বাঁকে তেঁতুলের গাছ থাকে
তেঁতুল পাকতে থাকে ক্রমে।
কুমির কামুক বটে ঠেলিয়া ডাঙায় ওঠে
পাকা-পাকা তেঁতুলের ভ্রমে।
ধীরে ধীরে বয় বায়ু, আরো ধীরে পরমায়ু
বেড়ে যায় মীন-সংসারে।
তুমি তো ধীবর জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে।
জল ও জালের খেলা সারাদিন সারাবেলা
মাছেরা মারছে খালি ঘাই
জাল সে তো নয়, চাঁদ, মায়া লাগানোর ফাঁদ,
ওরকম আমার যে নাই!
ওপারে মাছের দেশ, লীলার তো নাই শেষ,
আমি থাকি নদীর এপারে।
তুমি তো ধীবর জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে।
পূর্বা, পূর্ববাহিনী
অদিনে অক্ষণে এসেছ ভেসে ভেসে
এ কোন ঠিকানায়, প্রযত্নে!
অঙ্গে ধরে রাখি রূপের মতো করে
জানি না কোথা থেকে কোথায় বয়ে যায়
পূর্ববাহিনীরা, স্রোতসহ।
উৎস কোথা থাকে, জন্ম কোথা হয়,
কিংবা কোথা ধায় মেঘবহ?
জন্মসূত্রের কি নাভিচিহ্নের
নানান চিহ্নের এত ভিড়ে
সত্যি চেনা দায় আসল পরিচয়
আকার ঢেকে যায় ধীরে ধীরে।
সকল চিহ্নের বিনাশ হলে তবে
প্রকৃত রূপখানা পায় ফিরে
পূর্বদেশ থেকে পূর্বা এল তাই
সর্বসূত্রের ধারা ছিঁড়ে।
পূর্বা স্বাগতম। যে কোনো প্রকারের
চিহ্নসূত্রক ব্যতিরেকে
এসেছ বটে তুমি অদিনে অক্ষণে
বরণ করি তবু অভিষেকে।
রাগকৃষ্ণ
যে টানটান আবেগে ও আকর্ষণে
সমুদ্রের কোটি-কোটি টন পানি
আকাশে উড়িয়ে নিয়ে চলো তুমি মেঘের বাহনে,
যাবার পথেই যাও ঝরিয়ে খানিক...
যোজনজলীয় ভাবাবেশ ভেঙে নেমে এসো, থেকে যাও কিছুটা সময়।
আমি যে ময়ূর মেলে বসে আছি নিচে
আনমনা সাধিকার মতো, রসভ্রষ্টা, এলোমেলো...
বহুদূর পড়ে থাক হিমগিরি মেঘালয়, আরো দূর সাধের নির্বাণপুর।
ওহে ঘনশ্যাম মেঘ, আমার কৃষ্ণের রঙে রং, ওহে বলাহক,
তুমি যে যোজনবাষ্প রাগকৃষ্ণ আমার। তোমার মধুমালতী রাগের
ধারাবিবরণী ছাড়া অসম্ভব হয়ে ওঠে যুগলসাধন।
ঘনঘন রসভ্রম ঘটে, যোগভঙ্গ হয়...
আমার এ নিত্যলীলা, পেখমবিলাস, হায়, বৃথা যায় যায়...
রাগ করে হলেও, মুখটি কালো করে হলেও তো একবার
সম্প্রচার করো ধারাবিবৃতি তোমার।
শ্যামরঙা সত্য আর ধবল মিথ্যার মাঝে যেইটুকু ধূসর প্রভেদ,
ঘুচিয়ে দিয়ে তা ধীরে ধীরে
প্রথমে কালচে, পরে ভস্মিল ধূসর, আরো পরে ধবল বাদল হয়ে
নেমে এসো মেদিনীমণ্ডলে, অধীনার ভাঙা টিনের কুটিরে--
কালো সত্য ক্রমে বদলে দিয়ে এক সফেদ মিথ্যায়।
Tags
কবিতাগ্রন্থ