কবি ও কবিতার কথা
আলোচনায়: সাগর ইসলাম
আমার দৃষ্টিতে কবিতা হচ্ছে হৃদয়ের পসরা। জমিজমার মালিক হতে যেমন জমিনের পসরা থাকা আবশ্যক তেমনি একজন মানুষের হৃদয়যোগ্য মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে হৃদয়ে কবিতা থাকা আবশ্যক। শুধু কবি নয় প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই কবিতা থাকে। যে ব্যক্তির সারাজীবন কেটেছে নষ্ট রাজনীতির ক্ষমতা চড়ানো রাখাল হয়ে সে ব্যক্তির বুকেও নেমে এসেছে ষোড়শী শ্বাসানন্দের মাতাল রাত। উত্তেজনার বনে চুমু হয়েছে খরগোশ, কাঙ্খিত দু'জোড়া চোখে মেতে উঠেছে হরিণ নগরের গান; যেখানে ঘামের সাথে, ইশারার পেটে, নরম মাংসের গোপন উচ্চারণে কবিতা কাটিয়েছে মুগ্ধ হাওয়ার যৌবনকাল। শুধু তাই নয় একটা লাশও কবরে কিংবা চিতা খানায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে হাজারো কবিতা বলতে থাকে, যার নিভৃত শ্রোতা শোকনিবাসী মানুষ! একজন ভিক্ষুক যখন কবিতা বলে তখন তাকে অত্যন্ত অসহায় দেখায়। ভিক্ষুক যদি অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলতে না পারে তখন তাকে ভিক্ষুক বলে মনে হয় না। ভিক্ষুকদের ইনকাম নির্ভর করে অসহায়ত্বের গভীরতায়। যার অসহায়ত্ব যতো বেশি প্রখর সে ততোবড় ভিক্ষুকে ধনী। ভিক্ষুকদের এই এই জাগানিয়া অসহায়ত্ব কবিতা। একজন কবির কবিতা আর সাধারণদের কবিতার পার্থক্য কেবলই শিল্পের। কবিদের কবিতায় শিল্প পায় শিল্পের বিস্তার, সাধারণদের কবিতায় শিল্প পায় শিল্পের স্বীকার। সাধারণদের এই শিল্প স্বীকার কবিতায় সাধারণদের কোনো কষ্ট করতে হয় না। জন্ম, অবস্থান, সময়, পরিস্থিতি, প্রকৃতি আপনাআপনিই লিখে দেয়। কিন্তু একজন কবির শিল্প বিস্তার কবিতায় কবিদের দিতে হয় তিন অধিক প্রচুর প্রচুর প্রচুর... শ্রম। একজন প্রকৃত কবি কবিতার জন্য যে শ্রম দেয় তার চার ভাগের এক ভাগ শ্রম দিয়ে বিল গেটস হওয়া যায়।
কবিদের কবিতা আপনাআপনিই হয় না, প্রকৃতি কবিদের সে সুবিধা দেয়নি। কবিদের কবিতা হতে মগজ, ধ্যান, জ্ঞান, বোধ, সুন্দর কল্পনা, ব্যর্থতা, আনন্দ, মুগ্ধতা, সুস্থ অভিজ্ঞতা সবই লাগে। সবচেয়ে বেশি যেটা লাগে তা হলো মগজের সাথে মেটাফরসিস প্রেমরস বোধ। কবিতার ক্ষেত্রে প্রেম শব্দটি সহস্ররূপি। একজন কবি মন খারাপ হবার সাথেও প্রেম করতে পারে। মন খারাপ হবার সাথে প্রেম হওয়া একটি অনেকতম গুণ। সাধারণদের মন খারাপ হওয়া একটা বিরাট সমস্যা। সাধারণদের মন খারাপ থাকলে ঝগড়া, অভিমান, মারামারি, খুনাখুনি এবংকি আত্মহত্যারও আশঙ্কা থাকে। একজন কবির মন খারাপ হলে নতুন কোনো কবিতা পায় জন্মের সংবাদ! জেদ করে মঙ্গলগ্রহে উচিতের চাইতে বেশি সময় কাটানো যায়, জেদ কিংবা জোর করে কবিতা লেখা যায় না। কবিতা যে আবার নাযিল হয় ঐশ্বরিক কোন প্রতিভায় তেমনও নয়। কবিতা আদতে কীভাবে লেখা যায় কেমন করে হয়ে যায় তা বলা অনিশ্চিত। একজন কবি ভাত খাওয়া বা না খাওয়ার মতো নিশ্চিত বলতে পারেন না তিনি আজ কবিতা লিখবেন বা তিনি আজ কবিতা লিখবেন না। তবে এতোটুকু বলা যায় - কবির অন্তরের ধ্যানালব্ধ অভিজ্ঞতা আচমকাই যখন মস্তিষ্কে বর্ণহাতুরীর কোমল পেটা করে তখনই রূপান্তর হতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কবিতা। এই অনাকাঙ্ক্ষিত কবিতার নির্দিষ্ট কোনো বর্ডার নেই, স্কেল নেই, নেই কোনো ব্যাকরণীয় রীতিনীতি।
কবিতা হচ্ছে মানুষের অনুভূতির ব্যাকরণ। মানুষের অনুভূতি যখন শব্দসমষ্টির সাথে দলবদ্ধ হয়ে একটি সুন্দর ব্যাকরণ তত্ত্বের মতো মুগ্ধতা ছড়ায় তখনই তা কবিতা হয়ে উঠে। যেমন - 'তোমার গায়ের জল বাষ্প হয়ে উড়ে মিশে গেলো মেঘে, সে মেঘ গলতে গলতে বৃষ্টি হয়ে নামে তোমার চালেই; তুমিও হারাতে হারাতে হও বাষ্প, বাষ্প হয়ে উড়ে যাও আমার চোখাকাশে মেঘ হয়ে জমে রও হাজার বছর, মাঝেমাঝে চোখ বেয়ে মেঘ নামে কান্না হয়ে, গড়িয়ে পড়ো সেই আমার বুকেই!' - এটা একটা মানুষের হানিয়ের যাওয়া প্রিয়জনকে নিয়ে ভাবনাগত অনুভূতি৷ যে অনুভূতি একটি সুন্দর ব্যাকরণরূপ ধারণ করেছেন ব্যক্তিদহনচিত্ত মুগ্ধতায়। সে নেই তবু আছে। হাঁড় মাংসের মানুষটি তরল নোনাজল হয়ে বুকে মিশে যাচ্ছে অনুভূতির ব্যাকারণগত রূপান্তরে। আমার দৃষ্টিতে এটাই কবিতা।