মুক্তগদ্য: সাগর ইসলাম
এক সহগামী কবি বলেছিল- 'সাগর সহজ হও। তুমি ও তোমার ভাষারা কবি। তোমার ভাষার সকালে যাদের এখনো ঘুম ভাঙেনি তারা ব্যর্থ বিকেলে তোমার মেজাজে ফটকা ফাঁটাতে আসবেই। এ নিয়ে তুমি আক্ষেপ রেখো না। যে কবিদের পিঠ আড্ডায় ঠেকে গেছে আর কবিতা ঠেকে গেছে জীবনানন্দের দেয়ালে সেখানে তোমার আমার নামে দু-চার কেজি বানোয়াট ক্যাসেট অপবাদের সুরে বাজিয়ে দেয়া হবেই। আমাদের মানতে হবে- বাঘের নামে শেয়ালপাড়ায় যে গীবত চলে তা জঙ্গলই পায় বন পায় না!'
আমিও বুঝে নিলাম সহগামীর সুন্দর সব বিবরণ। বুঝে নিলাম- সমাবেশের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মি. আবালেরও দোষ আছে এমন- মঞ্চে যে উঁচুমানের আবাল ভাষণ দিচ্ছে প্রধান অতিথি হিসেবে সে ভাবে তার চেয়ে সে আরো বড় মাপের প্রধান অতিথিযোগ্য আবাল। আবাল নিয়ে আবালদের এসব ভাবনা স্বাভাবিক। কবিরাও তেমন সব কবি হয় না কিছু আবাল কবিও থাকে। জীবনানন্দকে ভালোবাসতে বাসতে যেসব কবি আটকে গেছে 'ঝরা পালক থেকে বনলতায়' তাদের শব্দদুষণকে না রেগে বরং আমার করুণা করাই কর্তব্য। একদিন ট্রামের মায়া আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মদের কবি কবি নেশা কেটে গেলে সাগরের কবিতা ও কবিত্ব ওদের হোমিওপ্যাথি হিসাবে কাজে দেবে। কবি ও কবিতা উভয়ই উভয়ের সৃষ্টিকর্তা- যদি সাদা সত্য হয় তবে সেদিন ওরা বুঝবে কবিতার আকাশে এখনো ওরা ভাষার জিব্রাইল নামাতে পারেনি। ওদের ভাষায় দানায় দানায় তৈয়ার হয় এখনো ধূসর পাণ্ডুলিপির লোকমা। এখনো যাদের শব্দের মেজাজে ঘাস পাতা আর প্যাচার খিটখিটে দরদ উঁকি মারে তাদের ভিন্ন কোনো পোয়েট্রি পাওয়ার নেই। যেটুকু আছে সেটুকু স্ক্রিপ্টজয়ী অভিনয়ের সর্বোচ্চ শিক্ষানবিশ পদবি- নায়ক নামডাকের মতো ভাব-টাব। ভাব আর পাওয়ার এক নয়। যেমন এক নয় রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ হয়ে ওঠা। কবিতার ট্রেন থেকে জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথকে ফেলে দিয়েছিলেন বলেই জীবনানন্দ একাই পৌঁছেছিল গন্তব্যের নতুন স্টেশনে। যুদ্ধের শেষে যার কোনো প্রতিপক্ষ থাকে না তাকেই তো ক্ষমতাকর বলে এবং তার নিয়মসমগ্রই তো হয়ে ওঠে কেবল ক্ষমতা। এখন আমি যদি ক্ষমতাকর হতে চাই কবি ও কবিতায় তাহলে মদ খেয়েই হোক আর ভাত না খেয়েই হোক জীবনানন্দ নামক প্রতিপক্ষ রাখা যাবে না মানে এক ইঞ্চিও রাখা যাবে না। শব্দের আউশ ধান মাড়াই করে নরম আটা বানিয়ে যদি তুলতুলে ভাষার হালুয়া ও নরম রুটি বানাতে নাই পারি তবে সেসব শব্দধানের চাষ আমি করবো কেন? কবি প্রধান দেশে গেরস্ত কবি কি কম আছে নাকি? সেখান থেকেই কিনে নেবো খেয়ে নেবো যা প্রয়োজন! যাই হোক সংলাপ আর বাড়াবো না মূল পয়েন্টে আসি। সাগর সেসব কবিতা লিখে না যেসব কবিতা অতীতের কথা বলে অতীতের আদলে, বর্তমানের কথা বলে বর্তমানের মেকাপে। সাগরের কবিতা অতীত, বর্তমান কিংবা মানুষগ্রস্ত হলেও তার ভাষায় ভাষায় থাকে ভবিষ্যতলোভী চরম উত্তেজনা। বাক্যের মেদে মেদে ভিন্নরেখার তরুণ লেয়ার। কথিত শিল্পের সর্বশেষ পোস্টমর্টেম থেকে যার আরেকটি শিল্পের কেবিনঘর শুরু তার হাসপাতালে কোনো পুরোনো কবিৎসকের আনাগোনা নেই। এ শিল্পের হাসপাতালে সকল রোগই নতুন সকল রোগীও নতুন এবং নতুন সকল ডাক্তারি কবি-কায়দা। এক লাইনে অনেক কবিই কবিতা লিখেছে কিন্তু সাগরের মতো করে শিল্প চিকিৎসা দেয়নি যে বাক্য রোগী পেয়েছে- 'পৃথিবীর শেষ মানুষটার কাছে বিক্রি হবে না কাফনের কাপড়' এমন শূন্যতত্ত্বের ঔষধি স্বাদ। মানুষের নির্মমতা হিংস্রতা অমানবিকতা নিয়ে কেউ এমন সুন্দর মেটাফোর কথা বলেনি- 'সম্পর্ক মূলত ঋণাত্মক সংখ্যা'। ভালোবাসায় শাহজাহান সবাই হতে চায়, সমর্পণে সবাই রাজা কিন্তু সাগরের মতো পরমতত্ত্বের জাদুবনে প্রেমিক-প্রেমিকাদের এমন নরম করে লোহা প্রতিবাদ করতে পারেনি- 'পুলসেরাত পাড় হতামই তোমায় না ভেবে হাঁটলে'! ধর্মগ্রন্থের বাণীর মতো যদি কবিত্বের ভাষা ও ভাব প্রয়োগ আলাদা নাই হয় তাহলে সে কিসের কবি ও কবিতার স্রষ্টা? যে মৌলিকত্ব নতুন নয় নিজের নয় সে মৌলিকত্ব জাহির করা তো পয়গম্বরের কাজ। যেসব পয়গম্বরী কাজ করে গেছেন নুহ, জাজুস, কৃষ্ণ'রা! পয়গম্বরদের মৌলিক কোনো ক্ষমতা থাকে না এদের শুধু থাকে গভীর ধ্যান সাধনায় লাভ করা ঐশ্বরিক কিছু দিকদর্শন লাঘব করা। তারা তাই করে তাদের ঈশ্বর তাদের যতোটুকু ইশারার অধিকার দেয়। আজকালের অনেক কবিরাই পয়গম্বর কবি। এরা অনেক ঈশ্বর কবির ভালোবাসার ছায়ায় ঈশ্বর কবিরই দিকদর্শন / ইশারা মেনে চলে এবং সেভাবেই লিখে। মানুষ তো সাধারণের চেয়েও সাধারণ হতে পছন্দ করে। এই অতি সাধারণ মানুষের তৃতীয় চোখে ধূলো দিয়ে পয়গম্বর কবিরা অনায়াসেই নিজেকে ঈশ্বরকবিতূল্য বলে প্রচার করে এবং সমাজে তারা স্বার্থকও হয়। যদিও এই স্বার্থকতা পুরোটাই মিথ এবং ক্ষণস্থায়ী। মাইকেল, রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, নিজার, বাজথুন ইত্যাদি জন ঈশ্বর কবি ছিলেন বলেই তারা এখনো স্থায়ী, বেঁচে আছেন। তাদের সময়ে বহু পয়গম্বর কবি ছিলেন যাদের লেখা মৃত লাশের মতো বিলিন নিঃচিহ্ন হয়ে গেছে। অতএব আমারও বুঝতে হবে- আমি কি ঈশ্বর কবি নাকি পয়গম্বর কবিতেই সীমাবদ্ধ থাকবো। আমার কবিতা কি জীবনান্দের কবিতার পয়গম্বরী করবে নাকি ভবিষ্যত্বের ঈশ্বর কবিতা হবে তার উপর ডিপেন্ড করেই আমার ভাবনারা হবে ভাষা ও চিন্তাশক্তির মৌলিক লেবার। আমি তাই বলবো যা পৃথিবী প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যেই আছে কিন্তু আমি তা সেভাবেই বলবো যেখানে আমি ছাড়া অন্য কারো বলার চিহ্ন রঙ ছায়া ওজন কিছুই থাকবে না। ইলুমিনাতি সম্পর্কে মানুষ জানিয়ে দিয়েছেন বহু আগেই। আমার যদি জানানোর থাকে তবে আমি তাই জানাবো যেখানে উঠে আসবে ইলুমিনাতির চাইতেই ভয়াবহ সুন্দর ট্রান্সফরমেশন গড মাইন্ড। যে গড একজন মানুষও হতে পারে অথবা হতে পারে প্রকৃতির কোনো ইগোট্রিপ ন্যাচারাল সিস্টেম!