আদিত্য আনামের গল্প
ভ্রম ও ভীমরতির গল্প
বউটা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। অসুস্থ বউটার মত হিকমতের মনটারও একই অবস্থা। রাতের খাবার রান্না করতে করতে হিকমত নানান ভাবনা ভাবতে থাকে। হিকমত রান্না করতে পারে না। আবার হোটেলের খাবারও তৃপ্তি করে খেতে পারে না। বউটা সুস্থ হতে সময় লাগবে। তাই অগত্যা নিজের রান্না করা ছাড়া আর কোনো বেটার অপশন আপাতত তার হাতে নেই। হিকমত ইউটিউব দেখে দেখে রান্না করতে থাকে। ভাত রান্না থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভর্তার রেসিপি, মাছ রান্নার রেসিপি, মাংসের রেসিপি, খিচুড়ি, বিরিয়ানি, তেহারি কি নেই ইউটিউবে! সমস্ত রান্নার রেসিপি এবং টিউটোরিয়াল ভিডিওসহ দেওয়া আছে। শুধু সার্চ করা দরকার। হঠাৎ বউটা অসুস্থ হয়ে পড়ায় হিকমত অফিস থেকে সপ্তাহখানেকের জন্য ছুটি নিয়েছে। বউ কি জিনিস তা সে হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছে। মাত্র তিনদিন বউটা অসুস্থ হয়ে পড়াতে হিকমতের গোটা দুনিয়াটাই যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। একেকটা দিন যেন একেকটা বছরের মত দীর্ঘ আর ক্লান্তির লাগছে তার কাছে। হিকমত ভীষণ একাকিত্ব অনুভব করতে থাকে।
বাসায় ওরা দু'জন মাত্র মানুষ। সাত বছর হল ওদের বিয়ে হয়েছে। এখনো কোন বাচ্চা-কাচ্ছা হয়নি। অবশ্য বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ওদের বিশেষ কোন মাথাব্যথাও নেই। আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুরা একটু প্যারা দেয়। কিন্তু ওসব আজাইরা প্যারা ওরা ইগনোর করা শিখে গেছে। এখন আর ওসবে তেমন কিছু যায় আসে না ওদের। রান্না শেষ করে হিকমত প্লেটে খাবার বেড়ে বিছানায় নিয়ে যায়। হিকমত গল্প করতে করতে বউকে খাবার খাইয়ে দেয় এবং নিজেও খেয়ে নেয়। তারপর ডিনার শেষ করে তাকে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে হিকমত একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে বসে। সময় কাটে না তার। একা একাই টিভি দেখতে হয়। অথচ কয়েকদিন আগেও টিভির রিমোট নিয়ে ওদের ঝগড়া হতো নিয়মিত। হিকমত খবর দেখবে কিন্তু ওর বউ সিরিয়াল দেখবে। এরকম বিষয় নিয়ে প্রায়শই ওদের ভিতরে ঝগড়া হতো। হয়ত ঝগড়াটা ওদের অবচেতনেই অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছিল। টিভির রিমোটটা হাতে নিলে হিকমতের মনের ভিতরে কেমন যেন একটা খারাপ লাগা কাজ করে। হয়ত শূন্যতা। হিকমত বুঝতে পারে সে তার বউকে খুব মিস করছে। সাথে ঝগড়াটাকে মিস করছে। কয়েকদিন ধরে বাসাটা কেমন শুনশান লাগছে।
রাত ক্রমশ বাড়তে থাকে। চ্যানেলগুলোতে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় একই নিউজ প্রচার হচ্ছে। দুপুরের পর থেকে আর নতুন কোন নিউজ নেই। হিকমত একটার পর একটা চ্যানেল চেঞ্জ করতে থাকে। হঠাৎ একটা চ্যানেলে গিয়ে ওর রিমোটের বোতাম আটকে যায়। লেইট নাইট টকশো 'লাইভ উইথ দ্য লিজেন্ড' অনুষ্ঠানটি চলছে। এই অনুষ্ঠানে সাধারণত দেশের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন আসেন। তারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংকট ও সম্ভবনা নিয়ে তাদের বিশ্লেষণমূলক ও জরুরী আলাপ আলোচনা করেন। কিন্তু হিকমত দেখতে পায় আজকের অনুষ্ঠানটিতে অতিথি হিসেবে এসেছে একটা ছাগল। হিকমত অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে থাকে সে হয়ত স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু না, একটু পরই তার মনে পড়ে যায় সেই ছাগলটার কথা। গতমাসে একটা ছাগল সম্পর্কে সে পত্রিকায় একটা নিউজ পড়েছিল। এই ছাগলটা হয়ত সেই ছাগলটাই হবে। অফিসে যাওয়ার সময় জব্বার কাকার টং দোকানে বসে চা খেতে খেতে হিকমত পত্রিকায় ছাগলের নিউজটি এক ঝলক পড়ে নিয়েছিল। তখন পত্রিকায় ছাগলের ছবিসহ বড় করে হেডলাইন দিয়ে খবরটি ছেপেছিল। এক প্রত্যন্ত গ্রামে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। হয়ত পৃথিবীর বিরল এক আশ্চর্য ঘটনা। হত দরিদ্র কৃষক আক্কাস মিয়ার পালের একটা ছাগলের দুইটা বাচ্চা হয়। তার ভিতরে একটা বাচ্চা অবিকল মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে। এতোটাই অবিকল যে ছাগলটা ওই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায়ও কথা বলতে পারে। ছাগলটাকে এক পলক দেখার জন্য লোকজন হুমড়িখেয়ে পড়ছে আক্কাস মিয়ার বাড়িতে। ভিড়ের ভিতরে ছাগল দেখা নিয়ে তর্কাতর্কি থেকে মারামারি পর্যন্ত শুরু হয়ে যায়। মারামারি করতে করতে একজন মারা যায় আর বেশকিছু লোক গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে আক্কাস মিয়া তার ছাগল দেখার জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করে। সবার জন্য এক মিনিট করে বরাদ্দ থাকে। এক মিনিটের জন্য একশো টাকা। কোন কথা বলা যাবে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে এক মিনিট দেখবে। আর কথা বললে পাঁচশো টাকা। লোকজনের আগ্রহ তবু বাড়তেই থাকে। তারা টাকা দিয়ে টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে ছাগল দেখে। কেউ কেউ পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে টিকিট কিনে ছাগলের সাথে কথা বলে। নিউজটিতে ছাগলের ছোট্ট একটা সাক্ষাৎকারও ছেপেছিল। ছাগলটা নিয়ে সারাদেশে বেশ হৈচৈ পড়েছিল। হিকমত শুরুতে অন্যান্যদের মতোই ঘটনাটি নিয়ে বেশ কৌতূহলী ছিল কিন্তু পরে সে তার অফিসের কাজ আর বউয়ের অসুস্থতার কারণে বিষয়টি সাময়িকভাবে ভুলে গিয়েছিল। আজকে ছাগলটাকে চ্যানেলে দেখে সত্যিই সে অবাক হয়। আরো অবাক হয় ছাগলটা একদম প্রমিত বাংলায় কথা বলছে দেখে। শিক্ষিত মানুষের মত ছাগলটাও ভাষাজ্ঞান রপ্ত করে ফেলেছে। হিকমত মনে মনে ভাবে, 'ভূতুরে আমজনতা না হয়ে এরকম একটা রাম ছাগল হতে পারলেও শান্তি। ছাগলটা কত ট্যালেন্ট! কি সুন্দর করে কথা বলছে। আহা। নিশ্চয় ছাগলটা জীবনে অনেক উন্নতি করবে এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।'
হিকমত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর আরেকটা একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে খুব মনযোগী হয়ে টিভিতে ছাগলটার কথা শুনতে থাকে আর তাকে দেখতে থাকে। হিকমত খেয়াল করে, ছাগলটা বেশ বড় হয়ে গেছে। পত্রিকায় যখন তার ছবি ছাপা হয়েছিল তখন সে অনেক ছোট ছিল। ছাগলটা হয়ত রাম ছাগল হবে। ছাগলটার কান আর পা-গুলো বেশ লম্বা।
টিভিতে দেখা যাচ্ছে ছাগলটা বড় ফ্রেমের একটি চশমা পড়ে সোফায় পা তুলে বসে আছে। মনে হচ্ছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোন বুদ্ধিজীবী কিংবা দার্শনিক বসে আছেন। তার পাশে বসে আছে তার মালিক আক্কাস মিয়া। সে লুঙ্গি পড়ে সোফায় বসে চুকচুক করে কফি খাচ্ছে। কফিতে চিনি কম হয়েছে। খেতে খুবই জঘন্য আর তিতা লাগছে তবুও খাচ্ছে। আসলে আক্কাস মিয়া লজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। তার খুব লজ্জা লাগছে। আক্কাস জীবনে কোনদিন চা-ই খায়নি, কফি তো দূরের কথা। সে মনে মনে ভাবতে থাকে এত বিশ্রি জিনিস মানুষ খায় কি করে। এর চেয়ে গরম ভাতের ফেন সুস্বাদু।
ছাগলটার সামনে কফির কাপ এবং কিছু কঁচি কাঁঠালপাতা রাখা আছে। সে কফি এবং কাঁঠালপাতা দুটোই খায়। ছাগলটা হয়ত কিছুক্ষণ আগেই কফি খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। তার পেয়ালা শূন্য। নিশ্চয় চ্যানেল কর্তৃপক্ষ কিছুক্ষণ পর তাকে আরেক কাপ কফি দিবে। এবং সে এক চুমুকে সেটা সাভার করে ফেলবে। মানুষের মত চুকচুক করে দীর্ঘক্ষণ ধরে সে কফি খেতে পারে না। ওভাবে তার সমস্যা হয়। হয়ত বিরক্তিও লাগে। যাইহোক, ছাগল আর তার মালিকের মুখোমুখি উৎসুকভাবে দু'জন উপস্থাপক বসে আছে। তারা ছাগলটাকে নানারকম প্রশ্ন করে যাচ্ছে আর ছাগলটা বিজ্ঞ অধ্যাপকের মত একটা গুরু-গম্ভীর ভাব নিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে যুক্তিসহকারে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে তারা আক্কাস মিয়াকেও প্রশ্ন করছে কিন্তু আক্কাস মিয়া শুধু মুচকি হাসছে, সে কোন কথা বলতে পারছে না। ক্যামেরার সামনে লজ্জায় সে এমনি কালো, আরো কালো হয়ে যাচ্ছে। আক্কাস মিয়া একপ্রকার বিপদেই পড়েছে। এই ছাগলের বাচ্চাটা যেদিন থেকে জন্ম নিয়েছে তারপর থেকে আক্কাসের চোখে ঘুম নেই। কোন অবসর নেই। নানান জায়গা থেকে নানান লোকজন এসে সারাক্ষণ মাছির মতোন ভীন ভীন করতে থাকে তার বাড়িতে। শুরুর দিকে তার এই ব্যাপারটি খুবই বিরক্ত লাগত। এখন হয়ত সেটা কিছুটা কমেছে। কিংবা নেই বললেই চলে। কারণ পত্রিকা, টিভি চ্যানেল আর ইউটিউবাররা দৈনিক তাকে যে টাকা পেমেন্ট করে তা আক্কাস মিয়া ছয়মাস কামলা বেচেও পাবে না। আক্কাসের কপাল, তার শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। সে করেও। আক্কাস মনে মনে এটা ভেবে খানিক আনন্দ পায় যে, তাকে আর আগের মত কামলা বেচতে হয় না। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও সে কোনদিন সংসারের অভাব দূর করতে পারেনি। কিন্তু ছাগলটা তা পেরেছে। ছাগলটা তার সম্পদ। তার ভিজিট বাবদ দৈনিক যে টাকা আসে তা দিয়ে বেশ রাজার হালেই চলে যাচ্ছে দিনকাল। সঞ্চয়ও ভাল হচ্ছে তাদের। তাছাড়া কয়েকটি টিভি চ্যানেল আর ইউটিউবাররা এসে তার সাথে চুক্তিও করেছে। আক্কাস মূর্খ মানুষ, নিজের নাম লিখতে পারে না। অবশ্য এসব ঝামেলা টিপসই দিয়ে সেরে ফেলতে হয় তাকে। ওরা চুক্তিপত্র পড়ে শোনায় আক্কাসকে। তারপর আক্কাস রাজি হলে টিপসই দেয়। ওরা ছাগলটাকে নিয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠান করবে। তারা আক্কাস মিয়াকে কিছু টাকা অ্যাডভান্সও করে রেখেছে। এটা নাকি এখন পাবলিক ডিমান্ড। এই মুহুর্তে লোকজন ছাগলের কথা ছাড়া আরকিছু শুনতে চাচ্ছে না। ইউটিউব আর টিভি চ্যানেলগুলোতে ছাগলের অনুষ্ঠান ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠান-ই চলছে না। শুরুতে মিডিয়াগুলো বেশ আগ্রহ নিয়ে ছাগলের নিউজ করত কিন্তু আস্তে আস্তে সারাদেশে সেটা এত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে যে, এখন তাদের বাধ্য হয়েই ছাগলকে নিয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতে হচ্ছে। যুগটা নাকি ভাইরালের। ছাগলটা যেভাবে সারাদেশে ভাইরাল হয়েছে তাতে ব্যবসা-বাণিজ্য, যুদ্ধ, খুন-খারাপি, ছিনতাই ও ধর্ষণের মত কোন অপরাধেই মানুষের বিন্দুমাত্র কোন আগ্রহ নেই, ভ্রুক্ষেপ নেই। ছাগলের রাজ্যে গোলাপের মূল্য ঘাসের সমান। দেশের আমজনতার ছাগলামি নিয়ে কেউ কেউ খুবই চিন্তিত। দেশটা রসাতলে চলে যাচ্ছে বলে তাদের ধারণা। অবশ্য তাদের কথায় কান দেয়ার মত সময় বা মস্তিষ্ক কোনটাই এইসব ছাগলাসক্ত জনতার।
হয়ত খুব শীঘ্রই আন্তর্জাতিকভাবেও ছাগলটা ব্যাপক ভাইরাল হবে বলে কোন কোন ইউটিউবার ভাইয়েরা স্বপ্ন দেখেছে। তারা আক্কাস মিয়াকে অগ্রীম পেমেন্ট করে কন্টেন্ট বানানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, ফেসবুক, ইউটিউব ও ইন্সটাগ্রাম সব জায়গায় শুধু ছাগল আর ছাগলাসক্ত লোকজনের পাগলামির খবর।
দীর্ঘসময় ধরে শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, বিনোদন ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলতে বলতে অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে এসে ছাগলটি খুব ইমোশনাল হয়ে পড়ে। তখন তার চশমার নিচ থেকে টপটপ করে পানি ঝরতে থাকে। উপস্থাপকগণ সমবেদনা জানিয়ে টিস্যু বক্সটা তার দিকে এগিয়ে দেয়। ছাগলটি টিস্যু নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে দর্শকদের ধন্যবাদ জানায় এবং বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বলে, 'আপনাদের প্রতি আমি খুব কৃতজ্ঞ। আপনাদের ভালবাসা আর আগ্রহের জন্যই আমি আজ এখানে। আমার সমস্ত সফলতার কৃতিত্ব আমি আপনাদেরকেই দিতে চাই। আজকের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমি কিছু বিশেষ ঘোষণাও দিতে চাই। নিশ্চয় আমার ভক্তরা সেই ঘোষণা শুনে আনন্দিত হবেন।
ঘোষণা-০১: ইউটিউবার ভাইদের জোড়াজুড়িতে আমি কিছু গান করেছি। শীঘ্রই আমার গানগুলো বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল এবং টিভি চ্যানেলে একে একে প্রকাশ করা হবে। নিশ্চয় ছাগ-সঙ্গীত মানুষকে মুগ্ধ করবে এবং আমি আমার ভক্তদের কথা চিন্তা করে লাইভ কনসার্ট করার জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছি।
ঘোষণা-০২: আপনাদের খুব পরিচিত এবং স্বনামধন্য এক পরিচালকের সাথে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমায় চুক্তি হয়েছে। শীঘ্রই পরিচালক এবং সিনেমার নাম প্রকাশ করা হবে।
ঘোষণা-০৩: আগামী বইমেলায় আমার একটি আত্মজীবনিমূলক বই বের হবে। আশাকরি বইটি মানবসমাজের মনস্তাত্বিক বিকাশে এবং সভ্যতার উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।
ঘোষণাগুলো শেষ হল। আশাকরি আমার পাগলা ভক্তরা এভাবে ভালবাসা দিয়ে সারাজীবন আমার পাশে থাকবেন। আবারও ধন্যবাদ। শুভরাত্রি।'
অনুষ্ঠানটি শেষ হওয়ার পরও টানা পনেরো মিনিট সতেরো সেকেন্ড হিকমত অবাক হয়ে হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে। সত্যি বলতে হিকমতও ছাগলটির ফ্যান হয়ে যায়। আর হবে নাই-বা কেন, সে আজ অবধি কোন মানুষকেও এত সুন্দর করে কথা বলতে দেখেনি। ঘোষনাগুলো শোনার পর হিকমত কিছুটা উত্তেজিত ও আগ্রহী হয়ে ওঠে কখন তার প্রিয় সেলিব্রিটির গান শুনতে পারবে। পৃথিবীতে নানান ভাষার গান সে শুনেছে কিন্তু ছাগলের গান কখনো শোনেনি। তাছাড়া ছাগলটার অভিনিত সিনেমা দেখার জন্যও সে খুব আগ্রহী হয়ে ওঠে। ভালো সিনেমার অভাবে দেশ থেকে সিনেমা হল প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। ছাগলের সিনেমাটি রিলিজ হলে সে স্ব-পরিবারে সিনেমা হলে গিয়ে দেখবে বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে।
বেশকিছুদিন কেটে যাওয়ার পর, হিকমতের বউটা সুস্থ হয়ে ওঠে। তারা পূর্বের মত সুখী দাম্পত্য জীবনে ফেরে। তারপর হিকমত একদিন অফিসে যাওয়ার পথে খেয়াল করে, শহরজুড়ে শুধু ছাগল আর ছাগল। আস্তে আস্তে সমস্ত শহরে আরো ছাগলের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। হিকমত খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সবাই নাকি এই আশায় ছাগল পালন করতেছে, যদি আক্কাস মিয়ার ছাগলের বাচ্চার মত তাদেরও একটা কথা বলা ছাগলের বাচ্চার জন্ম হয়। অফিসে কলিগদের কানাকানিতে জানা গেছে, তাদের বসও নাকি কিছু ছাগল কিনেছে অফিসের ছাদে একটা ছাগলের খামার করার জন্য।
এদিকে আক্কাস মিয়া নিয়মিত টিভি চ্যানেলে আসছে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করছে। এখন তার বেশ পরিবর্তনও হয়েছে। সে আগের মত লুঙ্গি পড়ে আসে না। ফরমাল শার্ট-প্যান্ট আর শু পড়ে আসে। তাছাড়া সে আর আগের মত লজ্জাও পায় না। ছাগলের পাশাপাশি সে নিজেও এখন অনেক কথা বলে। কখনো কখনো হালকা রশিকতাও করে। সারাদেশে ছাগলের পাশাপাশি তার নিজেরও কিছু পাগলা ভক্ত তৈরি হয়েছে।
'টাকা কি জিনিস মাইরি। টাকা হলে মানুষ কত দ্রুত বদলে যায়' টিভি দেখতে দেখতে হিকমত কথাগুলো মনে মনে বিরবির করে বলতে থাকে। তার বউও আর সিরিয়াল দেখে না। ছাগলের অনুষ্ঠান তার প্রিয় হয়ে গেছে। তাছাড়া সে-ও ছাগলটির অনেক বড় ফ্যান হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে শহরজুড়ে অস্বাভাবিক হারে ছাগলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, ফ্ল্যাটে কিংবা ছাদে সমস্ত জায়গায় ছাগল দিয়ে ছেঁয়ে যায়। এর মাঝে সারাদেশে আরো কয়েকটা বিশেষ প্রজাতির ছাগলের জন্ম হয় যারা আক্কাস মিয়ার ছাগলের মতই সুন্দর করে কনফিডেন্টলি কথা বলতে পারে। ছাগলের প্রতি মানুষের আগ্রহ আর উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তেই থাকে।
একদিন হিকমতের বউ খুব করে বায়না ধরে বলে তারও একটা ছাগল চাই। সে হিকমতকে বোঝাতে থাকে পাশের রুমটা তো ফাঁকাই থাকে। হিকমতও আর দ্বিমত না করে রাজি হয়ে যায়। সে বাজার থেকে একটা ছাগল কিনে নিয়ে আসে। তার পকেটের অবস্থা ভাল না। বউয়ের অসুস্থতার জন্য অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। নয়ত আরোকিছু ছাগল সে কিনত।
হিকমত এবং ওর বউ নিজের সন্তানের মত যত্ন করে সেই ছাগলকে লালনপালন করতে থাকে। রাতে ছাগলের অনুষ্ঠান শুরু হলে তারা তাদের ছাগলটাকেও তাদের সাথে নিয়ে টিভি দেখতে বসে। তারা ছাগলটার সাথে কথা বলে। ছাগলটাকে কথা বলার প্র্যাকটিস করায়।
একরাতে ওরা ছাগলের অনুষ্ঠান শেষ করে ঘুমাতে যায়। হিকমত ঘুমের ভিতরে একটা স্বপ্ন দেখে। সে দেখে তাদের ছাগলটাও গর্ভধারণ করেছে। এবং একটা বাচ্চাও হয়েছে। সে কথা বলতে পারে কিন্তু একদল লোক এসে জোর করে তাদের কাছ থেকে নিয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটা। হিকমত খুব লড়াই করছে তাদের সাথে। লড়াই করতে করতে হঠাৎ হিকমতের স্বপ্নসহ ঘুমটা ভেঙে যায়। লাইট জ্বালিয়ে হিকমত কিছুক্ষণ বড় বড় করে শ্বাস নেয়। স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে। ফ্রীজ থেকে জলের বোতলটা বের করে ঢকঢক করে পেট ভরে সে ঠাণ্ডা জল পান করতে থাকে। তারপর কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলে সে খেয়াল করে তার বউ বিছানায় নেই। হিকমত কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে, তারপর পাশের রুমে গিয়ে দেখে সেখানেও তার বউ নেই। কিচেন কিংবা বাথরুমেও নেই। একটু পর সে কি যেন মনে করে দৌড়ে আবার পাশের রুমে যায়। হিকমত দেখতে পায় সেখানে এক জোড়া ছাগল শুয়ে শুয়ে জাবর কাটাচ্ছে। দৃশ্যটি দেখার পর হিকমতের চোখদুটো কপালে উঠে চড়ে বসে। বাজারে গিয়ে সে নিজে একটা ছাগল কিনেছে। ভুল হওয়ার কোন কথা না। বাসায় তো একটাই ছাগল ছিল। ঘুমাতে যাওয়ার আগেও একটাই তো ছিল। দুইটা হলো কীভাবে! হিকমত ছাগল দু'টির দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকে আর ভাবতে ভাবতে ভাবনার ভিতরে ঢুকে, সে ক্রমশ বিভ্রান্ত হতে থাকে। তবে কী তার বউটা...?
বাহ্ আদিত্য ভাই। বেশ লাগলো গল্পটা
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Delete