কবির সাথে আড্ডা: আদিত্য আনাম ও হাসনাইন হীরা
হরকরার সাহিত্য আড্ডা
আড্ডার কবি: আদিত্য আনাম ও হাসনাইন হীরা
আদিত্য আনাম: হীরা ভাই, কবিতা নিয়ে আপনার সাথে আড্ডা দিতে চাই। আপনার কবিতা চর্চা এবং কবিতার ভ্রমণ নিয়ে আলাপ শুনতে চাই। আচ্ছা, আপনি তো চাকরিজীবী, একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন দীর্ঘদিন ধরে এবং আপনি বিবাহিতও। সংসার-জীবন, চাকরিজীবনের মত দুর্ধর্ষ পরিস্থিতিতে থেকেও আপনি নিজেকে কীভাবে কবিতার জগতের সাথে সংযোগ ঘটান? কবি তো স্বাধীনচেতা, ইচ্ছেপ্রিয়, ভাব ও ভবঘুরেপ্রধান প্রাণি। প্রাত্যহিক জীবনের নানান দায়-দায়িত্ব, নিয়ম ও শৃঙ্খলের কাঁটাতার কীভাবে ক্রস করে কবিতায় আসেন? কখনো আহত বা ব্যাহত হোন না?
হাসনাইন হীরা: শুধু আহত না, রক্তাক্ত হই। অন্তর্গত সেই ক্ষরণ বা রক্ত কবিতার শব্দ হয়ে ঝরতে চায়। কিন্তু তা গুম করে ফেলি। গুম করাটাও আরেক রক্তাক্ত ঘটনা। কিন্তু গুম না করে উপায় নেই। শিল্প সাহিত্যে শিল্পীর নিজের উপস্থিতি শোভনীয় নয়। ঐটা তার ব্যক্তিগত কারুভাস। সেই রং দিয়ে সাহিত্যকে চরিতার্থ করতে চাই না। কবির ব্যক্তি জীবন দিয়ে কবিতা লেখা মেকি কাজ । তাতে কবিতার বামনত্ব ঘোচে না। আমার কাছে কবি হলো নতুনের প্রতিভূ। দূর-সমকালের এক অদ্ভূত প্রাণি। সমকালে থেকেও সে সমকালহীন। তার অভিসারের ব্যাপ্তি অনেক। ফলে কবির হৃদয় বরাবরই উন্মুক্ততা দাবি করে। কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের একটা লাইন আছে এরকম— ‘অমিতসম্ভাব্য কবি ভালোবাসে একার সন্ন্যাস’। এছাড়া কবি রহমান হেনরীর তার ‘সার্কাস মুখরিত গ্রামে’ বলেছেন, ‘ হবে না হবে না কিছু…/ জেনেগেছি যুগলে হবে না/ যৌথতায় আরো বেশি অসম্ভব হবে/ যদি হয়, হবে একা একা।’
কথাটা প্রবাদতুল্য সত্য । কিন্তু এই তৃতীয়বিশ্বে এর প্রযোজ্যতা একেবারেই ক্ষীণ। এখানে শিল্প-সাহিত্যে কাজ করতে আসা ম্যাক্সিমামই মধ্যবিত্তের যাতক। এদের কাছে ফিন্যানসিয়াল দাবিটাও অনেক বড় একটা দাবি। সেখানে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক যুগযন্ত্রণা তাকে টেনে ধরতে চায়। সেটা নিজেকে দিয়েই অনুভব করি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সব মানুষই তো সংগ্রামশীল। কবির সংগ্রাম আরো ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। সেই আভাস থেকেই উঠে দাঁড়াবার চেষ্ঠা করছি।
আদিত্য আনাম: হ্যাঁ, কিছু লিখতে হলে একা হয়ে যাওয়াটা খুব জরুরি। শুধু লেখকেরা নয়; জগৎ জুড়েই সৃষ্টিশীলদের ভিতরে এই বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। পাখিরা যেমন খুব ভোরে বেরিয়ে পড়ে পৃথিবীর নানান পথে-প্রান্তরে। সমস্ত দিনের ক্লান্তি ও কোলাহল শেষে উদরে আহার এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে নীড়ে ফেরে। আবার যখন ডিম দেয়ার সময় হয় কিংবা বাচ্চা ফুটাতে তার পালকের উঞ্চতার প্রয়োজন হয় তখন সে আবার একা হয়ে যায়, বিস্তৃত জগৎ থেকে কিছুটা সে আড়াল হয়ে থাকে, নীড়ে থাকে। কিন্তু ডিম দেয়া শেষে, বাচ্চা ফুটানো শেষে সে পুনরায় বেরিয়ে আসে। তাদের এইযে জগতজুড়ে বিচরণ, ওড়াউড়ি, আহার অন্বেষণ, নীড়ে ফিরে যাওয়া এবং সময়ের প্রয়োজনে একা হয়ে যাওয়া—এই বিষয়টি প্রাকৃতিক এবং চমৎকার। শুধু একা হয়ে থাকা পাখিরা তো খাঁচার পাখি। প্রয়োজনীয় নিজস্ব একাকীত্ব শেষে কবিকেও তো পাখিরদের মতো ঘোর কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে হয় নতুন চিন্তার আহার এবং অভিজ্ঞতার তাগিদে, ওড়াউড়ি ও অন্বেষণের তাগিদে। সেজন্য ঘোরাঘুরি এবং আড্ডারও হয়তো দরকার আছে। এ-বিষয়ে আপনি কী বলেন?
হাসনাইন হীরা: পাখির ভূমিকাটা খুব ভালো বলেছো। জৈবিক ও সৃজনের অন্বেষণ প্রকৃতির স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু কবির একাকিত্ব ও অন্বেষণের ব্যাপারটা একটু আলাদা। কবি ভিড়ের মধ্যে থেকেও সে একা। কবি সব কিছুকে পরখ করে, কিন্তু সব কিছু কবিকে পরখ করতে পারে না। কবির তাগিদটা চেতনাবদ্ধ। সেটা বিকাশের ব্যাপার। এই বিকাশ নানা পর্যায়ে হতে পারে। তার মধ্যে পাঠ অনিবার্য একটা প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া দু’ধরনের হতে পারে। একটা সে পৃথিবীর সংগঠিত জ্ঞানজগত থেকে সরাসরি নিতে পারে। যার সহায়ক হতে পারে বই, নাটক, সিনেমা, চিত্রকলা। অন্য পাঠ চুকাতে পারে দেখার ভেতর দিয়ে। এজন্য কবিকে বেরিয়ে পড়তে হয়। রবীন্দ্রনাথের দুটো লাইন আছে না!—’দেখা হয় নাই চু্ক্ষু মেলিয়া/ ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া’। এটা এক বিস্ময়কর পাঠ। এই পাঠই কবিকে বেশি সহায়তা করে। কবি যা শুনছে, যা দেখছে, তা তাঁর জগত নয়। এই দুইয়ের ভেতর একটা ঐক্য তৈরি করাই কবির আসল কাজ। এই সুড়ঙ্গ দিয়েই কবি মৌলিক জগতের ভেতর প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে আড্ডা একটা প্রাইমারি ফর্ম। বুদ্ধদেবের ভাষায়- ‘আড্ডা হলো জ্ঞান পাকানোর কারখানা’। কারণ আমরা যা কিছু সৃষ্টি করি বা কল্পনা করি না কেন! তার একটা অস্তিত্ব খুঁজি। আড্ডা তারই একটা সমন্বয়ক।
আদিত্য আনাম: কবিদের কাছ থেকে অনেক সময়ই শোনা যায় যে, কবিতাটি দুর্বল হয়েছে বা পুরোপুরি কবিতা হয়ে ওঠেনি কিংবা কবিতাটি চমৎকার হয়েছে। নিশ্চয় কবিতায় এমন কিছু শাশ্বত বিষয় আছে যার সংকট বা অভাব থাকলে কবিতা ঠিক কবিতা হয়ে ওঠে না, শূন্যতায় ভোগে, কিছু কমতি থাকে। একজন সচেতন পাঠক হয়তো কিছুটা অনুমান করতে পারে সেটা কিন্তু পুরোপুরি অনুধাবণ ও অবলোকন তো কবিই করতে পারে। কবিতার কলকব্জা তো কবিই ভালো জানেন। আপনি কি কবিতার সেই শাশ্বত বিষয়টি স্বীকার করেন? যদি স্বীকার করেন তাহলে সেই শাশ্বত বিষয়গুলি কী কী যা আপনি কারো কবিতা পড়ার সময় খোঁজেন এবং নিজে লেখার সময়ও সেসব বিষয়ে সচেতন থাকেন?
হাসনাইন হীরা: নিশ্চয় কবিতার একটা শ্বাশত রূপ আছে। না হলে, কবিতা কেন এতকাল আমাদের ভ্রমণ-সঙ্গী হয়ে আছে? আমরাই বা কেন কবিতার ভেতর দিয়ে নিজেরা নিজেদের পরখ করে চলেছি? এটা শ্বাশত একটা ব্যাপার। তবে কবিতার শ্বাশত জিনিসটা একটা সাংগঠনিক অর্জন। এর সাথে বেশকিছু উপাদান জড়িত। যা ধাপে ধাপে সংগঠিত হয়। তার আগে কবিতার আলোচনায় নির্মাণকলা সামনে চলে আসে। এটা মিস্তিরি টাইপের ফাংশন। এই ফাংশনে স্ট্রাকচার ও স্ট্রাকচারের ডিজাইন এবং রং ব্যবহারের মতো কিছু ব্যাপার আছে। যেখানে শৈল্পিকতার দাবিটা অনেক তীব্র। কিন্তু এইগুলো একটা দর্শনদারি আলোচনা। এগুলোকে গুণবিচারি আলোচনায় নিয়ে যেতে পারে কবির দৃষ্টিভঙ্গি। সেইটা ঐ স্ট্রাকচারে ওঠা-নামার একটা যুক্তি নির্ভর সিঁড়ি। এই সিঁড়ি কতটা মজবুত তা দেখার বিষয়। ওঠা-নামার কাজটা যদি ব্যাহত হয়, তবে নির্মাণ অকেঁজো হয়ে পড়ে। তাই সিঁড়ির প্রযোজ্যতা এড়ানো যায় না। এই সিঁড়িটা কবিতার শ্বাশতের উপাদানের একটা অংশ। আরেকটা অংশ হলো কবিতার ধ্বনি বা ব্যঞ্জনা। যার সাথে সুরের একটা গভীর পরকীয়া সম্পর্ক আছে। যা কবিতাকে গতিশীল করে তোলে। এই নির্জনতম সুরের খোঁজ পেলেই পাঠক কবিতার দিকে যাত্রা করে। কবিতাও যাত্রা করে অপর পাঠক ও সময়ের দিকে। কবিতার এই যাত্রা বা ভ্রমণ মানব যাত্রার সাথে সম্পর্কিত। যার ভেতর দিয়ে আমরা নিজেদের আত্ম আবিস্কারের একটা সংকেত পাই। নিজেদের অস্তিত্ব অনুভব করি। বিমহিত হই। অতীতকে পরাস্ত করি এবং অনাগত সমকালের দিকে এগিয়ে যাই। কবিতা হয়ে ওঠে আমাদের সূর্যসারথি। আমরাও কবিতার উপরে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। কবিতার প্রতি এই হস্তক্ষেপ খুব এনজয় করি। ফলে অন্যদের কবিতা পড়ার সময়ও এর তাগিদ জাগে। না পেলে হতাশ হই।
আদিত্য আনাম: আমাদের সমসাময়িক সময়ে কবিতার সমালোচনাকে সমালোচনা করা হয়, অনেকেই সমালোচনাকে অপছন্দ করেন। যার যা ভালো লাগবে, ইচ্ছে করবে সে তেমন লিখবে। কবির এই স্বাধীনতা এবং সমালোচোনাকে কিভাবে দেখেন?
হাসনাইন হীরা: সমালোচনা মানেই কবির স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করা নয়। সমালোনা তো কবির সৃজনশীলতার জ্বলন্ত চুলায় বাতাস দেয়া। যাতে আগুনের গতি বাড়ে। কিন্তু মুশকিল হলো, এখন সেই পর্যায়ের সমালোচনা অনুপস্থিত। এখনকার সমালোচনা কবিতার পোশাক ধরে টানাটানির মতো। আব্রুহীন করার মতো একটা বিষয়। মানে কাঠামোর বাইরে যেতে পারে না। অনেকটা উপদেশ বা পরামর্শমূলক। ফলে নতুন কবি সেই আলোচনাকে ভয় পায়। রিলকে একটা কথা বলেছেন, ‘নতুন কবিকে কোনো উপদেশ দিতে নেই’ । উপদেশ নবীন কবির গলা কেটে দিতে পারে। মানে সে, কবিতা থেকে সরে যেতে পারে। অথবা তাঁর স্বতন্ত্র জায়গাটা নষ্ট হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত ক্রিটিক করা মানে, কবিতার মনন নিয়ে আলোচনা করা। যার একটা ঐতিহাসিক বা দার্শনিক ভিত্তি থাকবে। সেটা হয়না বলেই কবিতা এখন আগাচ্ছে কম।
আদিত্য আনাম: কবিতায় গল্পময়তা নিয়ে অনেকে কাজ করে। অর্থাৎ কবিতার ভিতরে গল্প বলা এবং ন্যারেটিভ করে কবিতা লেখা, পাঠক যেন কবিতা বুঝতে পারে এবং তা আবৃত্তি করতে পারে সহজে। এরকম একধরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যারা আবৃত্তিচর্চা করেন তাদের কাছে প্রায়ই একটা কথা শোনা যায় তা হল ‘আবৃত্তিযোগ্য কবিতা’। কবিতার এইসব বিষয় এবং কবিদের বা আবৃত্তিকারদের এইসব বক্তব্য বা প্রবণতা নিয়ে আপনার অভিমত কী?
হাসনাইন হীরা: কবিতার আদলে গল্প লেখা যায়। গল্পের আদলে কবিতা লেখা তর্কতুল্য বিষয়। আবৃত্তির দোহাই দিয়ে যারা কবিতার সরলতা কাম্য করে, তারা মূলত বাহুল্যতা বাড়ায়, সহজ শিল্পের পূজারি হয়ে জনপ্রিয়তাকে বেশি কদর করে। কবিতা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান খুবই কম। কবিতার গায়ে গল্প বা ফিকশনের হাওয়া লাগলে, কবিতার আত্মায় লালিত সুখ ভারাক্রান্ত হয়। পানসে পানসে লাগে। মনে হয়, কবিতা তার দাম্পত্য জীবন হারিয়ে ফেলেছে। কারণ, কবিতার শৈল্পিক দাবিটা হিমাদ্রীর শিখর স্পর্শ করার মতো দুর্লভ। ফিকশনের সেই জৌলুষ নাই। ফলে এই প্রবণতায় গল্প থেকে কবিতাকে ডিফাইন করা মুশকিল। এইগুলোকে কাব্যিক গল্প বলা ভালো। কারণ, এই প্যাটার্নের কবিতা টানা-গদ্য-ভঙ্গিতে বেশি মানানসই। আমার মনে হয়, দূরসমকালে বাংলা গল্পের ভাষালংকার ফিকশনালাইস্ট কবিতার জায়গায় পৌঁছে যাবে। তখন এই কবিতা তার জন্ম পরিচয় হারিয়ে ফেলবে। হা হা…
তোমরা তো শব্দমঙ্গলে কবিতা নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছো। তোমরা আরো ভালো বলতে পারবে। কবিতায় গল্পের এই দখলদারি বা উপনিবেশ কি শোভনীয়?
আদিত্য আনাম: কবিতায় গল্পের দখলদারি কখনোই শোভনীয় হতে পারে না। আমি একটা কথা প্রায়ই বলি সেটা হল, কবিতায় যারা গল্প বলে গল্পে তারা কী বলে? কবিতা এবং গল্প এই দুইটা সেক্টর তো আলাদা। গল্প যখন কবিতায় এসে কবিতার দখলদারিত্ব করে বা কবিতাকে গ্রাস করে ফেলে তখন সেটা ক্ষতিকর। তখন কবিতা আর কবিতা থাকে না, সেটা হয়ে যায় কাব্যিক গল্প (Poetic fiction)। কবিতায় যদি গল্পের আগমন খুব জরুরি হয়ে পড়ে, তাহলে আসতে পারে, তবে অবশ্যই কবিতার অতিথি হিসেবে আসবে, কবিতার নিয়ম মেনে আসবে, দখলদারিত্ব বা গ্রাস না করলেই হলো।
আমরা শব্দমঙ্গলে চর্চা করি নতুন কবিতা লেখার, কবিতার নতুন ভাষা ও অলংকার খোঁজার। প্রচলিত ভালো কবিতা লেখার চেয়ে আমরা নতুন কবিতা লেখাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কবিতা নিয়ে নানান পরিক্ষা-নিরীক্ষা (Experiment) করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। ‘শব্দমঙ্গল’ একটি পিওর লিটল ম্যাগাজিন।
আমি শুধু শব্দমঙ্গল নয়, অর্বাকেও লিখেছি। অর্বাকের অনেক আড্ডায়ও ছিলাম। অর্বাকেও একই ধরণের উদ্দেশ্য নিয়ে কবিতার চর্চা হয়। আপনিও তো অবার্কের একজন। অর্বাকে আপনার কবিতার জার্নিটা কেমন ছিল অর্থাৎ অর্বাক নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত এবং কবিতার অভিজ্ঞতাগুলো জানতে চাচ্ছি।
হাসনাইন হীরা: অর্বাক নতুন কবিতা আন্দোলনের একটা প্ল্যাটফর্ম। নিরীক্ষা প্রবণতাই অর্বাকের মূল বিষয়। ভালো কবিতার চেয়ে নতুন কবিতা লেখা অর্বাকীয় কবিদের চ্যালেঞ্জ ছিল । কবিতা নিয়ে বহু আন্দোলন হয়েছে। ‘কল্লোল’কে কেন্দ্র করে ত্রিরিশের কবিরা আধুনিকতার বুনিয়াদ গড়ে তুলেছিল। ‘হাংরি’কে কেন্দ্র করে কলকাতার ষাটের কবিরা, ইউরোপের দাদা ইজমের এক্সটেনশন ঘটিয়েছে বাংলা কবিতায়। এ দু’টো আন্দোলনই বাংলা কবিতার জন্য বড় মুভমেন্ট। তার পরবর্তী জায়গাটা অর্বাকের কথা চিন্তা করা যায়। সেটা তুমি অর্বাকের কবিদের কবিতা পড়লেই বুঝতে পারা যায়। দ্রাবিড় সৈকত, সিলভিয়া নাজনীন, মহিম সন্নাসী, সালেহীন শিপ্রা, সঞ্জয় ঘোষ, অরবিন্দ চক্রবর্তী, সূর্যমুখি, চাঁদনি মাহরুবা, স্বরলিপি, সুমন ইউসুফ, ফরহাদ নাইয়াসহ আরো অনেকের কবিতা পড়লেই অর্বাকীয় একটা ভাষা খুঁজে পাওয়া যায়। অথচ প্রত্যেকের কবিতাই স্বতন্ত্র।
বলা যায়, অর্বাকে যারা কবিতা চর্চা করতে আসে, তারা নিজেরাই ভেঙেচূড়ে চেঞ্জ হয়ে যায়। অনেকটা জার্মান কবি গ্রেটের সেই পাইন গাছের গল্পের মতো। যেখানে গ্রেটে বলতে চেয়েছেন, পাইন গাছের কাছ দিয়ে যে যায়, সে ফেরার সময় আর আগের মানুষটি থাকে না। পাইনের সরলতা, স্নিগ্ধতা, হৃদ্যতা ও সবুজতায় বদলে যায়। অর্বাকে সেরকমটাই ঘটে। নিজের বেলাতেও তাই ঘটেছে । অর্বাকে এসে আমার কবিতা বদলে গেল। কবিতার কেন্দ্রীক চিন্তাভাবনাও বদলে গেল। মনে হলো যা লিখেছি, সমকালীন কবিতা থেকে তার দূরত্ব অনেক। সুতরাং তরুণদের কবিতা পড়তে হবে। শুরু হলো কবিতার নতুন জার্নি। মনে হলো, আধুনিক কবিতা থেকে কবিতাকে উৎরাতে হবে। আবার উত্তারধুনিক চিন্তাও কবিতাকে ভালো কিছু প্রমোট করবে না। সেই এক চ্যালেঞ্জিং জায়গা থেকে কবিতা করছি। অর্থাৎ লিটল ম্যাগাজিনের যে মেজাজ, যে আন্দোলন হয় বা হওয়া উচিত অর্বাক তারই ফলাফল। সুতরাং লিটল ম্যাগাজিনের গতি ও ঘরানাতেও অর্বাকের স্বকীয়তা আছে। বাংলাদেশে এমন একটা প্রত্রিকা দেখাতে পারবে কি? তুমি হয়তো ‘লোক’র কথা বলবে, ‘লিরিক’ কিংবা চিহ্ন’র কথা বলবে। ‘শব্দমঙ্গল’র কথা তো বললেই। এগুলো কিন্তু এত কবিকে সম্পৃক্ত করতে পারে নাই, যা অর্বাক করেছে। সুতরাং অর্বাক নতুন কবিতা আন্দোলনের ইতিহাসের অংশীদার, এ কথা কি অস্বীকার করতে পারবে?
আদিত্য আনাম: হ্যাঁ, এটা তো অবশ্যই স্বীকার করি যে, বাংলাসাহিত্যে অর্বাক একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে থাকবে এবং শুধু অর্বাক নয় শব্দমঙ্গলও বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে। আপনি অর্বাক সম্পর্কে যতটা জানেন হয়তো শব্দমঙ্গল সম্পর্কে কিছুটা কম তথ্য পেয়েছেন। কারণ শব্দমঙ্গলের কবিদের সংখ্যাটাও অর্বাকের চেয়ে কম হবে না বরং আরো বেশিই হবে হয়তো। শব্দমঙ্গলের কবিরা একটু ইন্ট্রোভার্ট টাইপের, প্রচার বিমুখ এবং সম্ভবত তারা আড়ালে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। শব্দমঙ্গলের কবিদের পাওয়া যায় না, তাদের খুঁজে নিতে হয় (হা,,হা)। শব্দমঙ্গলের কবি আসাদ সনি, নুরুল ইমরান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, দিদারুল লিমন, শারমিন সামি, মাহমুদা স্বর্ণা, জবা রয়, সানজি সানজিদা, কুমার গৌতম এবং আদিত্য আনামদের কবিতাতেও আপনি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর পাবেন, নতুন কবিতার খোঁজ পাবেন। আমার ধারণা শব্দমঙ্গল আরো দীর্ঘদিন চর্চা চালিয়ে যাবে, ঠিক নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় যতদিন থাকবে। কারণ ত্রিশালে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিতার প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে শব্দমঙ্গল। প্রতি মঙ্গলবার ওখানে ঈদের দিনের মত লাগে। কখন সন্ধ্যা আসবে, কখন শব্দমঙ্গলের আড্ডা শুরু হবে। কবিতার আড্ডা যে এত তীব্র, আকর্ষণীয় এবং প্রাণবন্ত হয় তা শব্দমঙ্গলে না গেলে হয়তো বুঝতাম না। এক মঙ্গলবার শেষ হলে আরেক মঙ্গলবারের জন্য যে তীব্র অপেক্ষা, সেটা অনেকটা প্রেমিক-প্রেমিকাদের অভিসারের অপেক্ষার মতো। এখনো প্রতি মঙ্গলবার আমি আহত হই শব্দমঙ্গলের আড্ডার বিরহে।