পুলিশের ভূমিকা ও দায়িত্ব: বর্তমান বাস্তবতা এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন: আসিফ মোজাহিদ

পুলিশের ভূমিকা ও দায়িত্ব: বর্তমান বাস্তবতা এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন: আসিফ মোজাহিদ





একটি স্বাধীন দেশের অন্যতম স্তম্ভ হলো তার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ বাহিনী একটি জাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখে এবং জনগণের অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, যখন এই বাহিনী নিজেই জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন জাতির ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে পুলিশের ভূমিকা এবং তাদের কার্যকলাপ নিয়ে অনেক আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে, যা আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করছে।


ব্রিটিশ শাসনামলে পুলিশ বাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতো যাতে ঔপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখা যায়। সেই সময় পুলিশের প্রধান কাজ ছিল ব্রিটিশ সরকারের শাসন ব্যবস্থা রক্ষা করা এবং যেকোনো বিদ্রোহ বা বিরোধিতা কঠোরভাবে দমন করা। পাকিস্তান পিরিয়ড এবং স্বাধীনতার পরেও, আমরা লক্ষ্য করেছি, রাজনৈতিক দলগুলো পুলিশের এই ভূমিকা বদলাতে দেয়নি। তারা পুলিশকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।

বর্তমানে, পুলিশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব এতটাই গভীর যে, জনগণ পুলিশকে আর তাদের সেবক হিসেবে দেখতে পায় না। বরং, তারা পুলিশের আচরণে ভীতি ও অনাস্থা অনুভব করে। রাজনৈতিক আদেশ পালন করতে গিয়ে পুলিশকে প্রায়ই এমন কাজ করতে হয় যা মানবিকতা এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এর ফলে, পুলিশ বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা ক্রমশ কমেছে। প্রত্যেকটি সরকারই পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়, কারণ পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকা সহজতর হয়। কিন্তু, এর ফলে পুলিশ জনগণের সেবক হওয়ার পরিবর্তে ক্ষমতাসীন দলের সেবক হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে, পুলিশ বাহিনী কখনোই জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে না।

পুলিশ বাহিনীর মূল দায়িত্ব হলো জনগণের সেবা করা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা। তারা জনগণের করের টাকায় বেতন পান, তাই তাদের প্রথম দায়িত্ব জনগণের সুরক্ষা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি, পুলিশের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক আদেশ পালনের নামে ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যারা আন্দোলন দমনের নামে নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের কাজকে কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত বলা যায় না। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের মনে প্রশ্ন ওঠে, পুলিশের নৈতিকতা কোথায় গেলো? যখন একটি বাহিনী রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ করে, তখন সেই বাহিনীকে কীভাবে বিশ্বাস করা যায়?

সম্প্রতি পুলিশের পক্ষ থেকে উত্থাপিত দাবিগুলোও আলোচনার বিষয়। তাদের দাবি ছিলো নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ, নির্দিষ্ট ডিউটি আওয়ার এবং অন্যদের মতো সুযোগ-সুবিধা। কিছু দাবী যৌক্তিক হলেও, কিছু দাবি অত্যন্ত অযৌক্তিক। যেমন, তাদের দাবি ছিলো যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যে সকল পুলিশ সদস্য মারা গিয়েছে তার বিচার করতে হবে। কিন্তু, তাদের নিজেদের অপরাধের ফল কেন তারা মেনে নিতে চাইছে না?

পুলিশ দাবি করেছে যে, তারা কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে কাজ করতে চায় না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তারা রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজেরাই সেই দলের অংশ হয়ে উঠেছে। এছাড়া, পুলিশের দাবি ছিল সারাদিনে ৮ ঘণ্টার বেশি ডিউটি না করানো। একটি বাহিনীর জন্য এ ধরনের সময়সীমা নির্ধারণ অযৌক্তিক, কারণ জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্ব এমন কোনো সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকতে পারে না।

পুলিশ বাহিনী যদি নিজেদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন না করে, তবে তা জাতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। একটি স্বাধীন দেশের জনগণের প্রতি পুলিশের দায়িত্ব অনেক বেশি। কিন্তু, বর্তমান বাস্তবতায় আমরা দেখছি যে, পুলিশ বাহিনী তাদের ক্ষমতা এবং প্রভাব ব্যবহারে অত্যন্ত অসংযত হয়ে পড়েছে।

দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা এ নিয়ে শঙ্কিত। যদি কোনো বাইরের আগ্রাসন বা যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে আমাদের কি এই বাহিনীর ওপর নির্ভর করা যাবে? তারা কি সত্যিই দেশের সুরক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত? নাকি নিজেদের স্বার্থের জন্য পালিয়ে যাবে?

পুলিশ বাহিনীকে যদি সত্যিকারের জনগণের সেবক হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, তাহলে তাদেরকে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন নতুন আইন প্রণয়ন, যা পুলিশ বাহিনীকে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করবে। ব্রিটিশ শাসনের সময় যে আইন ও নিয়ম-কানুন ছিল, তা এখনো বহাল রয়েছে। এই পুরনো আইনগুলিকে বদলে নতুন নীতি ও নিয়ম-কানুন তৈরি করতে হবে, যাতে পুলিশ শুধুমাত্র আইনের শাসন রক্ষা করতে এবং জনগণের সেবা করতে পারে। এছাড়া, পুলিশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব কমাতে হলে তাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং পদোন্নতির প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ হতে হবে। এর মাধ্যমে, যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিরাই পুলিশ বাহিনীতে আসতে পারবে এবং তারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারবে।

পরিশেষে বলতে চাই, পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব এবং ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে তাদের ওপর জনগণের আস্থা রক্ষা করাটাও সমানভাবে জরুরি। তাদের আচরণে এবং দাবিতে যদি বৈষম্য, অসামঞ্জস্য এবং অযৌক্তিকতা থাকে, তবে তা শুধরে ফেলা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের দেশকে একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজে পরিণত করতে হলে, পুলিশের ওপর থেকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা এবং তাদের নৈতিকতার পুনর্জাগরণ প্রয়োজন। দেশকে রক্ষা করতে হলে, পুলিশ বাহিনীকেও সঠিক পথে পরিচালিত করা আবশ্যক।

Post a Comment

Previous Post Next Post