কবির সাথে আড্ডা: দ্রাবিড় সৈকত ও আদিত্য আনাম
আদিত্য আনাম: কুত্রাপির যাত্রা সম্পর্কে যদি একটু বিস্তারিত বলতেন অর্থাৎ কুত্রাপির
ভাবনা কখন এবং কীভাবে আপনার মাথায় আসলো?
দ্রাবিড় সৈকত:‘কুত্রাপি’ শব্দটি শুনলেই একটি খটমটে অনুভূতি হয়। কুত্রাপির যাত্রাও এমন ভাঙাচোরা রাস্তায়। প্রথাগত ভদ্র কবি সমাজের পক্ষে অস্বস্তিকর; কারণ সামান্য হেরফের করে বাংলা ভাষায় একই কবিতা সবাই লিখছে। অর্বাকে (লিটলম্যাগ) আমাদের প্রচেষ্টা ছিল নতুন কবিতা লেখার, পুরোনো কবিতা নতুন করে লেখার অর্থহীন কসরত থেকে বাংলা কবিতার মুক্তি অত্যাবশ্যক। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ নেয়ার দম খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর নতুনত্ব, অভিনবত্ব বা সৃজনশীলতার প্রাথমিক শর্তই হলো প্রথাকে অতিক্রম করে যাওয়া। একই পুরাতন চক্রে ঘুরপাক খেয়ে নিজেদের অনেকেই কবি মনে করার বিভ্রমে আমরা ভুগি। দেখতে কবিতার মতো কিছু দুর্বল রচনাও তাতে উৎপাদিত হয়। নিকৃষ্ট মানের রচনার চেয়ে না লেখাই শ্রেয় বলে মনে হয় আমাদের। কিন্তু কবি কিংবা শিল্পীদের অধিকাংশই কবিতা কিংবা শিল্প ব্যাপারটাই বোঝেন না। অনেকে এমনকি এসব বিষয়ে পড়াশোনা করারও দরকার মনে করেন না, ফলে কবিতার নামে ভাবালুতা সর্বস্ব আবর্জনা তৈরি হচ্ছে প্রচুর। বাংলা কবিতার বিষয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো অন্তত গত ১০০ বছর ধরে এটি কোথাও যেনো আটকে আছে, আমরা খুব সরলভাবে বলি জীবনানন্দ দাশের পরে বাংলায় কোনো কবিতা লেখা হয়নি, হয়েছে তাঁরই নানামাত্রার অনুকরণ। অতি অনুল্লেখযোগ্য কিছু বাঁক তো আছেই, তবে যে অর্থে বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাস-আলাওল থেকে মধুসূদন দত্তকে আলাদা করা যায়, যে অর্থে মধুসূদন থেকে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল থেকে জীবনানন্দকে আলাদা করা যায় সেই অর্থে আলাদা কোনো স্বর, শৈলী বা ধারা গত ১০০ বছরে বাংলা কবিতায় তৈরি হয়নি। এখন চলছে প্রলম্বিত জীবনানন্দের কাল। কোথাওবা ঈশ্বগুপ্ত-সত্যেন্দ্রনাথ চলছে, কোথাও পুরোদস্তুর মধ্যযুগ ফিরে এসেছে। এসব বিষয় একটি ভাষার জন্য, ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর জন্য এবং তাদের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত বিপযর্য়কর। নতুনত্ব ছাড়া, মৌলিকত্ব ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প শিল্পের জন্য নেই। আর সমৃদ্ধ শিল্পকলা ও মননের সংশ্রব ছাড়া এই বন্ধ্যা সময় থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ নেই।
তো নতুন স্বাদের, ধরনের, শৈলী কিংবা কাঠামো নিয়ে অর্বাকে আমরা বহুমাত্রিক নিরীক্ষা করার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম, নতুন ধারার রচনার চলমান নিরীক্ষা ও আকাঙ্ক্ষা থেকেই কুত্রাপির সূত্রপাত। নতুন কোনো কিছুর সুবিধা এবং অসুবিধা দুটি দিকই আছে, অসুবিধা হলো তাকে যথাযথ শনাক্তকরণের সমস্যা। কিন্তু নতুন কিছু করার জন্য অবশ্যই জানতে হয় পূর্ববর্তী ঘটনাবলি, সেসব বিষয়ে পর্যাপ্ত জানাশোনা ছাড়া নতুনত্বের নামে পুরাতনের চর্বিতচর্বণ হয়ে যাবার আশঙ্কা তো থাকেই। নিরীক্ষার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দিক হলো এর কোনোকিছুই না হবার সম্ভাবনা থাকে, কুত্রাপির মাধ্যমে বলা যায় আমি এমন একটি ঝুঁকি নিয়েই শুরু করেছি। আমরা ঝুঁকি নিয়ে নিজেকে বাতিল করে দেবার সাহস সঞ্চয় করেছি এবং নিরাপদ, আরামদায়ক, পুরাতন পথে চলার চেয়ে নতুনত্বের জন্য আমরা খ্যাতি-প্রতিপত্তির আসক্তিকে উড়িয়ে দিয়েছি। এমনকি প্রভূত দুর্নামের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত আছি।
আদিত্য
আনাম: কুত্রাপির নাম 'কুত্রাপি' কেন? এই নামকরণের পিছনে কি কোন বিশেষ তাৎপর্য আছে?
দ্রাবিড় সৈকত: কুত্রাপির নাম কুত্রাপি হবার প্রথম কারণ হলো, প্রথম রচিত কুত্রাপিটিতে এই শব্দটি গাঁথুনির প্রয়োজনেই এসেছিলো; সেখান থেকে শব্দটিকে নেয়ার কারণ এর রহস্যময়তার ইশারা। দ্বিতীয় কারণ হলো এই শব্দটির অর্থ (কোথাও, কোনো জায়গায়); এর অর্থে অনির্দিষ্টতা থাকলেও এটি স্থানিকতার দিকে ইঙ্গিত করে; মানুষের জন্য, ভাষার জন্য ভূ-বাস্তবতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। লোকাল শরীরে গ্লোবাল মনের থাকে বিপরীত টানাপড়েন। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের আন্তর্জাতিকতা নয়, আধুনিকতা এই লোকাল পরিচিতি মুছে দিয়ে আধিপত্যবাদীর বিশ্বায়ন প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। উত্তরাধুনিকতা বৈচিত্র্যময় স্থানিকতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। পরিচিতি মুছে দিয়ে সবাইকে দাস বানানোর বাইরে স্থানিক পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য কুত্রাপি নামের সাথে জড়িত। তৃতীয় কারণ হলো এই শব্দের ধ্বনিগত ব্যঞ্জনা, কুত্রাপি উচ্চারিত হবার সাথে এর রূপ-রস-ভাব-সৌন্দর্য-কদর্যতার সম্পর্ক আছে। চতুর্থ কারণ হলো এই শব্দটি অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত, যা কুত্রাপির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্যের সাথে সংগতিপূর্ণ। পঞ্চম কারণ হলো এই শব্দটিতে কেমন যেনো একটা শয়তানি আছে, শুনলে পূতপবিত্র কিছু মনে হয় না। এমন আরো বেশ কিছু বিষয় এই কুত্রাপি শব্দটি ধারণ করে যা কুত্রাপি পড়লেও বোঝা যায় যে, তাইতো এটাইতো কুত্রাপি!
আদিত্য আনাম: আপনার লেখা প্রথম কুত্রাপি কোনটি ছিল সেটি মনে আছে কি?
দ্রাবিড় সৈকত: প্রথম কুত্রাপির স্মৃতি মনে আছে, আমি যখন অর্বাকের আড্ডায় প্রথম কুত্রাপিটি পড়লাম, আড্ডার সবাই প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। তারা আমার কাছে কোনোভাবেই এমন নিম্নমানের উদ্ভট একটি রচনা প্রত্যাশা করেনি। তাদের ধারালো কোপের নিচে আমি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে গেলাম। যে যার সাধ্যমতো নিন্দা করলো, অর্বাকের সুতীক্ষ্ণ সমালোচনা কবি মহলে কিছুটা পরিচিত। ঐসব সমালোচনা ভালো হজম ক্ষমতা না থাকলে নেয়া যায় না। অর্বাকে অনেক কবিই জীবনে একবার এসে দ্বিতীয়বার আর ঐ পথে পা বাড়ানোর সাহস করেনি, ‘কে হায় অনেক সাধের ও স্বপ্নের লেখা কবিতা খুড়ে বেদনা পাইতে আসে’। আমি মনে করি আমার হৃদয়-মন-প্রাণ অত্যন্ত শক্ত। অনেক দিনের নিন্দা সহ্য করার সাধনা থেকেই নিন্দা-মন্দ আমাকে কুত্রাপি থেকে টলাতে পারেনি। আমি একের পর এক লিখেই চললাম কুত্রাপি। কেনো যেনো ভালো লেগে গেলো এবং ক্রমাগত চর্চার ফলে দিন দিন এর প্রকরণ-ভাষা-শৈলী উন্নত হতে থাকলো; তারপর ধীরে ধীরে সমালোচনা কিছুটা স্তিমিত হয়ে প্রশংসার দিকে বাঁক নিতে থাকলো।
কদাচিৎ কুত্রাপি গ্রন্থের ১৯৩ নম্বরে প্রথম লেখাটি আছে,
জলাশয় ভরা রাত/ সংশয়ে চাঁদ/ কাগজি লেবুর ফুলে/ ঝুল জানালায় বাদুড় পরাগি গান/ উত্থান শুধু উর্ধ্বাসনেই নয়/ পতন পারানি বোধন মুখর হলে/ সরু ফাঁদ বোম্বেটে ভাটির নিদ্রহীনতায়/ যায় জৌলুস আছাড়ি পিছাড়ি দম/ দুই কূলে/ নৌকাবিহীন লগ্ন নিয়তি লিপি/ কুত্রাপি নেই জেগে থাকে অবসাদ।
প্রথম কুত্রাপি বিশেষ ভালো কিছু হয়নি, তবু কিছুটা পক্ষপাত থেকে একে গ্রন্থবদ্ধ করা হয়েছে। এর একটি স্মারকমূল্য থাকতে পারে, এখন লিখতে গেলে নিশ্চয়ই এটি অনেকবার সম্পাদিত হতো। অর্বাকে সমালোচকগণের নিন্দা করাটা যথার্থ ছিলো।
আদিত্য আনাম: কুত্রাপি ৯ অথবা ১১ লাইন লেখার নিয়ম। যেকোনো একটা (৯ বা ১১) নয় কেন? এর কোনো বিশেষ মাহাত্ম্য আছে কী?
দ্রাবিড় সৈকত: মাহাত্ম্য অবশ্যই আছে। প্রথমত ৯ থেকে ১১ তে একটা গতিশীলতা আছে, যাকে এখানে ধরে রাখতে চেয়েছি। প্রচলিত নিয়মে জোড় সংখ্যায় পঙ্ক্তি বিন্যাস অথবা নির্দিষ্ট পঙ্ক্তি সংখ্যায় স্থির থাকাকে একটু নাড়িয়ে দিতে চেয়েছি। ৯ কিংবা ১১ না হওয়ার কারণ হলো একেবারে ধরাবাঁধা একটি জায়গায় আটকে যাওয়া থেকে এর কাঠামোকে স্বাধীনতার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে চাইনি। কুত্রাপিতে দেখা যাবে এমন অনেকগুলো ওপেন এন্ডিং বিষয় আছে, পঙ্ক্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও বিষয়টি বিবেচনায় ছিলো। আবার কুত্রাপি অনেক কমপেক্ট হওয়ায় বেশি বলাটা এখানে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। এর থেকে ছোট হলে জমে ওঠার বিষয়টি নষ্ট হতে পারে আবার বেশি হলে হয়ে যেতে পারে অতিকথন। তাছাড়া এই তথ্যবহুলতার যুগে মানুষের সময় খুবই কমে এসেছে, দীর্ঘ কবিতা পড়ার মতো অভিনিবেশ দেওয়া এ যুগের মানুষের পক্ষে কঠিন। কেউ বেশি পড়তে চাইলে বিকল্প হলো অনেকগুলো পড়ার সুযোগ আছে, যেমন কুত্রাপি নিয়ে আমার প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রন্থ মিলিয়ে ৫০৪ টি কুত্রাপি আছে।
আদিত্য আনাম: কুত্রাপি সম্পর্কিত একটি লেখায় আপনি বলেছেন কুত্রাপিতে অব্যবহৃত, পরিত্যক্ত ও অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার করার কথা। যে শব্দগুলো এখনকার লেখকেরা সচেতনভাবে এড়িয়ে যায় সেগুলোকে আপনি কবিতায় (কুত্রাপিতে) তুলে আনার কথা বলছেন ঠিক কী কারণে?
দ্রাবিড় সৈকত: প্রত্যেকটি শব্দের ইতিহাস আছে, ব্যঞ্জনা আছে, অর্থ ও অর্থের বিবর্তন-পরিবর্তন আছে, এগুলো ভাষা ও জ্ঞানতাত্ত্বিক জায়গা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনগোষ্ঠীর জ্ঞানসম্পদ সঞ্চিত থাকে তার বিপুল শব্দের ভাণ্ডারে। আমরা অনেক কিছুই পরিত্যাগ করেছি, অনেক কিছু গ্রহণ করেছি, এর ভেতরে নানামাত্রায় বিভিন্ন প্ররোচনা আছে, রাজনীতি আছে। আধুনিকতা আমাদের প্রাচীনকে, স্থানীয়তাকে বর্জন করতে শিখিয়েছে; আমরা বিনা বিবেচনায় অনেক কাজের জিনিস বর্জন করে ফেলেছি। আমাদের আত্মার সাথে শব্দের বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। আমাদের জ্ঞানভাণ্ডার, আমাদের শব্দভাণ্ডারের জং ধরা তালা না খুলতে পারলে আমরা তাকে চিনবো কী করে? বাংলা ভাষা ও শব্দ আমাদের বিবিধ ভ্রান্তির নির্মম শিকার। আমাদের প্রাচীন গ্রন্থাবলিতে আছে ‘শব্দব্রহ্ম’র বিষয়। শব্দের শক্তিকে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনে, ভাষার সমৃদ্ধিকে উপলব্ধির প্রয়োজনে কুত্রাপিতে অব্যবহৃত, পরিত্যক্ত ও অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার করার বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে। পৃথিবীব্যাপী শব্দ এবং ভাষা নিয়ে অনেক কবি-সাহিত্যিক-তাত্ত্বিক-গবেষক ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ করেছেন, সেসব উপাত্ত থেকেও আমরা জানি শব্দের গুরুত্ব এদের চলন-বলন-ধরন-বৈশিষ্ট্য-প্রকরণের বিবিধ বিষয়, কাজেই এমন জরুরি বিষয়ের পদচিহ্নকে আমরা যেনো ভুলে না যাই কুত্রাপি সেই কাজটি করতে চায়।
বঙ্গীয় সাংখ্যদর্শনে আছে ‘ন শব্দনিত্যত্বং কার্য্যতাপ্রতীতেঃ’ শব্দ ও অর্থ উভয়ই অনিত্য। এদের ব্যবহারকারী বিষয়গুলোতে মাত্রা যোগ করেন। উত্তরাধুনিকতার তাত্ত্বিক রোলাঁ বার্থ, দেরিদা, ফুকো এবং লাঁকার ভাষ্যেও আমরা এসবের প্রতিধ্বনি পাবো। স্ট্রাকচারালিস্ট, অ্যানথ্রোপলোজিস্ট কিংবা সেমিওটিশিয়ানদের খেলা শব্দকে কেন্দ্রে রেখেই। আমরা আমাদের শক্তিকে চিনতে ভুল করেছি। কুত্রাপি সেখানে মনোযোগ দিতে চায়। শব্দকে অবহেলা এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা বলেই আমি মনে করি। বাংলা ভাষা অনেক অপরাজনীতি শিকার হয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে। সেসব ইতিহাস না জেনে, তলিয়ে না দেখে আমরা অনেক শব্দের ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছি কুত্রাপি সেখানে নতুন আলো ফেলতে চায়।
আদিত্য আনাম: কুত্রাপিতে নির্দিষ্ট মাত্রা বা অক্ষর নেই (সনেট, হাইকু বা অন্যান্য ফরমেটের কবিতায় যেটা খুব গুরুত্ব দেয়া হয়) এই স্বাধীনতাটুকু কুত্রাপির নিজস্বতা ধরে ধারা জন্য কি ক্ষতিকর নয়?
কুত্রাপি নিজেই একটি নিজস্বতা। সনেট, হাইকু বা অন্যান্য ফরমেটের কবিতায় যে নিয়মের খড়্গ সেখান থেকে কবিতার জন্য একটি অপেক্ষাকৃত মুক্ত জায়গা হলো কুত্রাপি। অনির্দিষ্টতারও একটি নির্দিষ্টতা আছে যে, সে হলো অনির্দিষ্ট। এই স্বাধীনতাটুকু নিজস্বতা ধরে রাখার জন্য ক্ষতিকর হবার কোনো কারণ নেই, বরং এটিই কুত্রাপির শক্তির অন্যতম জায়গা। সপ্রাণ সজীব বিষয়ের মতো তার গ্রহণ করবার দরোজা উন্মুক্ত থাকলো। যেহেতু মৌলিক কাঠামোর কিছু নির্দিষ্টতা আছে তাই বিভিন্ন মাত্রা, ছন্দ ও অক্ষর বিন্যাসে চলতে গেলে তার সমৃদ্ধির পথটি উন্মুক্ত থাকবে।
আদিত্য আনাম: কুত্রাপির বৈশিষ্ট্যগুলোর ভিতরে আপনি বলেছে 'বাঙালিয়ানা'র কথা। তাহলে কি কুত্রাপি শুধু বাংলা ভাষাতেই লেখা সম্ভব? অন্যকোনো ভাষায় কুত্রাপি লেখা যাবে না?
দ্রাবিড় সৈকত: যেহেতু আমরা বাংলা ভাষায় লিখছি, তাই এই ভাষার কিছু নিজস্বতা, বৈশিষ্ট্য, মাধুর্য-কর্কশতাকে গভীরভাবে লক্ষ করার বিষয় আছে। অস্তিত্বের পরেই মানুষের ভাষা, বর্তমান পৃথিবীতে ভাষাই তার অস্তিত্বের গুরুত্ব নির্ধারণ করে। বাংলা ভাষার শক্তি সম্পর্কে আমাদের কবি-সাহিত্যিরা সচেতন নন, এই বিচ্যুতি দীর্ঘসময় ধরে ঘটেছে। বাংলাভাষী মানুষ তার ভাণ্ডারের অতি মূল্যবান শব্দাবলি বিভিন্ন কুঠুরিতে জমিয়ে রেখেছে। বাংলা ভাষা এবং তার বাস্তবতা কোনো শবদেহ নয়; তার সক্রিয়তা, বহুমাত্রিক অভিঘাত, নিত্য পরিবর্তনশীলতার গতি-প্রকৃতি, ভাষাকর্মীর নিত্য অনুধ্যানের বিষয়। বাঙালিয়ানা বলতে পুরো সাংস্কৃতিক বিষয় হলেও কুত্রাপির লক্ষ্য এখানে মূলত ভাষা। সক্রিয়, জীবন্ত ও চলমান ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ আছে। বাংলার ইতিহাস, ভাষার ইতিহাস এর জীবনদর্শন সম্পর্কে আমাদের চিন্তা-চেতনা তথাকথিত আধুনিকতা বিপর্যয়কর মাত্রায় দূষিত করে দিয়েছে; এই লোগোসেন্ট্রিজমকে অস্বীকার করা ছাড়া আমাদের পরিত্রাণের উপায় নেই। আমাদের আত্মাকে চিনতে না পারলে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার একটি সোনারপাথর বাটি; প্রাচীন পণ্ডিতেরা যে বলে গেছেন ‘আত্মানং বিদ্ধি’ তার দিকেইবা কেমন করে যাওয়া যেতে পারে। নিজেকে জানা না থাকার অর্থ পৃথিবীকে না জানার সমান। ভাণ্ডের ভেতর দিয়েই ব্রহ্মাণ্ডের পথে যাত্রা করতে হয়, তাই বাঙালিয়ানা এখানে নিজেকে উপলব্ধি, নিজের দেহ-সমাজ-ভাষা-রাষ্ট্র-প্রাণ-প্রকৃতি-পৃথিবীকে উপলব্ধির আওতায় নিয়ে আসার প্রয়াস।
অন্য ভাষার লেখার প্রসঙ্গে প্রথম উত্তর হলো অবশ্যই লেখা যাবে। কুত্রাপির বৈশিষ্ট্যাবলি অন্য ভাষার একই ধরনের গুণাগুণকে সহজেই আয়ত্ত করার ক্ষমতা রাখে। অন্যকোনো ভাষায় তাদের স্থানীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে রপ্ত করে করে তাদের নিজস্বতাকে কেন্দ্র করে রচিত হবে সে ভাষার কুত্রাপি। আমরা যখন সনেট বা হাইকু লিখি তখনো তাই হয়।
আদিত্য
আনাম: কুত্রাপি লিখতে গিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা হল কুত্রাপি লিখতে লিখতে একটা পর্যায়ে লেখক যা লিখতে চাচ্ছেন তার বাইরেও কিছু ব্যাপার চলে আসে অর্থাৎ সহজ করে বললে কুত্রাপি স্বয়ং কবিকেই ডমিনেট করে। এটা কি কুত্রাপির একটা অলিখিত (যা আপনি কুত্রাপির বৈশিষ্ট্যে বলেন নি) স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য?
দ্রাবিড় সৈকত: কুত্রাপির বৈশিষ্ট্যে এটি আলাদা করে বলা হয়নি, তবে এটি কুত্রাপির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য (যুক্ত করে দিতে হবে)। মজার ব্যাপার হলো আমরা আগে যে কোনো লেখায় ভাষা ও শব্দকে ডমিনেট করেছি, কারণ ভাষা ও শব্দের শক্তিমত্তাকে আমরা অবহেলা করে তাকে লেখকের ইচ্ছার দাস বানিয়ে রেখেছি, কুত্রাপিতে সেটি সম্ভব নয়। কুত্রাপি বাংলা ভাষার মতোই একটি জীবন্ত, চলমান ও বহুমাত্রিক ধারা। এখানে লেখক যতখানি স্বাধীন, লেখনী স্বয়ং তার মতোই স্বাধীন। কুত্রাপিতে একটি উত্তেজনাকর জার্নি আছে; আপনি যেহেতু কুত্রাপি লিখছেন আপনি জানেন যে, আপনি যেখান থেকে যে উদ্দেশ্যে লেখার যাত্রা শুরু করবেন লেখা শেষে আপনি দেখবেন অন্য কোথাও পৌঁছে গেছেন, মাঝখানেও হয়েছে কিছু বিচিত্র ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। এর বহুমাত্রিক গতিবিধি আপনাকে একই বিষয়ে ফোকাসড হয়ে থাকতে দেবে না। শব্দের শক্তি আপনাকে দিয়ে অনেক কিছুই লিখিয়ে নেবে। আধুনিক কবিতার কোনো ফরমেটেই এটি সম্ভব নয়। শব্দের এই ক্ষমতাকে আধুনিকতা নিজেই বুঝতে পারেনি। শব্দ-বাক্য-রচনা সম্পর্কিত আধুনিক ধারণাগুলো যথেষ্ট সংরক্ষণবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল। তবে একে অটো রাইটিং এর সাথে কোনোভাবেই গুলিয়ে ফেলা যাবে না, সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। অটোরাইটিংয়ে আমরা অবচেতনকে উন্মুক্ত করে দেয়ার চেষ্টা করি, সেই চেষ্টাটি লেখক নিজেই সচেতনভাবে সজ্ঞাত প্রয়াসে করে; কিন্তু কুত্রাপিতে শব্দের শক্তি চালিত করবে, আপনাকে বহুবৈচিত্র্যময় পথের পরিভ্রাজক করে তুলবে, আপনি বাধ্য হবেন শব্দের শক্তিকে অনুভব করতে; এটি কুত্রাপির একটি অন্যতম স্বাতন্ত্র্য। এই বৈশিষ্ট্যের সম্ভাবনাও বহুমুখী।
আপনাকে ধন্যবাদ যে এই বৈশিষ্ট্যটি আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছেন।
আদিত্য আনাম: কুত্রাপিতে অন্যান্য কবিতার মতোন কেন্দ্র থাকে না। ঠিক উত্তরাধুনিক কবিতা যেমন বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে থাকে কুত্রাপিতেও তাই হয়। কুত্রাপি কি উত্তরাধুনিক চিন্তারই প্রকাশ নাকি এই বিকেন্দ্রীকরণ উত্তরাধুনিকতার বিকেন্দ্রীকরণ থেকে আলাদা?
দ্রাবিড় সৈকত: কুত্রাপি অন্যান্য কবিতার মতো নয়, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও চালচলন কুত্রাপির। আধুনিক কবিতার সাথে এর সাদৃশ্য অতি সামান্য। এখানে ছন্দ-ব্যঞ্জনা-মাত্রার ব্যবহার, ভাষা ও শব্দের শক্তিকে উন্মুক্ত করা, লেখকের একচ্ছত্র আধিপত্যের অস্বীকার, অর্থকে নির্দিষ্ট খোপ থেকে বের করে দিগ্বিদিগ ছড়িয়ে দেয়া, পঙ্ক্তি বিন্যাসের স্বতন্ত্র পদ্ধতি, খোলা সমাপ্তির রীতি, একক বিষয় থেকে বের হয়ে বহুমাত্রিকতাকে আশ্রয় করা ইত্যাদি বিবিধ কারণে কেন্দ্রমুখিতার ধারণা প্রচণ্ড চাপে থাকে। কেন্দ্র তৈরি করার বিষয়ে লেখকের সচেতন প্রয়াসের পরেও অধিকাংশক্ষেত্রেই সেটি সম্ভব হয় না এর বৈশিষ্ট্যগত কারণে। এটিকে পরিকল্পিত বিকেন্দ্রীকরণ না বলে বলা যায় বৈশিষ্ট্যগত বিকেন্দ্রীকরণ; এর সাথে উত্তরাধুনিকতার অমিল নেই। আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা নিয়ে অনেক কথা হয়, হবে। আমাদের জানা দরকার আমাদের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনকে। একরৈখিক, আধিপত্যবাদী, নিপীড়ক আধুনিকতার চেয়ে সেই বিবেচনায় উত্তরাধুনিকতাকে আমি প্রাসঙ্গিক মনে করি। এই টার্ম দিয়ে ব্যাপারটি বোঝা সহজ বলেই বলছি কুত্রাপির বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি উত্তরাধুনিক। সাথে এটিও মনে করিয়ে দিতে চাই এই উত্তরাধুনিকতা আমাদের বাংলার স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে এবং প্রাচীন জ্ঞানকাণ্ডের সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।
উত্তরাধুনিকতা কি বলছে? বলছে এমন কিছু কথা যা আধুনিকদের পছন্দ নয়। আধুনিকতা পরবর্তী সময়ের একগুচ্ছ চিন্তা-পদ্ধতির সমন্বিত নাম উত্তরাধুনিকতা, বেশ কিছু পরিভাষা দিয়ে উত্তরাধুনিকতাকে সহজে বোঝা যায়। উত্তরাধুনিকতার প্রভাবশালী উল্লেখযোগ্য তাত্ত্বিক পরিভাষাÑ সিমুলাক্রা, হাইপাররিয়েলিটি, ডেথ অব দ্য অথর, গ্রান্ডন্যারেটিভ, মাইক্রোন্যারেটিভ, ডিসকোর্স, রাইজোমেটিক, ইন্টারটেক্সুয়ালিটি, প্লুরালিজম, ডিকনস্ট্রাকশন, ফ্রাগমেন্টেশন ইত্যাদি দিয়ে মূলত বহুমাত্রিক সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করার প্রয়াস নেয়া হয়। আধুনিকতার সীমাবদ্ধতাগুলোকে অতিক্রম করা কিংবা আধুনিকতার একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোর প্রক্রিয়াটি সক্রিয় হচ্ছে উত্তরাধুনিক ধারণাগুচ্ছের মাধ্যমে।
রোলাঁ বার্থ ‘The Death of the Author’ রচনায় লেখকের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে পাঠকের পুনর্জন্মকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাছাড়া তাঁর আরো একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব হলো পুস্তকের বহুবচন (Plurality of text)। লেখকের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। অর্থকে নির্দিষ্ট করে দেয়ার আধুনিকতাবাদী কর্তৃত্ব নেই। ভাষা একটি গতিশীল প্রবাহ যেখানে নিশ্চয়তার বোধ নেই। অর্থক ও অর্থিতের অনিশ্চয়তাকে ভিত্তি ধরেই জ্যাক দেরিদা তাঁর বিনির্মাণ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। বাচক ও বাচ্যের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রয়েছে বলে বিবেচনার যেমন অবকাশ নেই তেমনি, একটি লেখনীকে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নির্ণয় করতে পারেন। ‘লোকে ব্যুৎপন্নস্য বেদার্থপ্রতীতিঃ’ লোকের ব্যবহারের মাধ্যমেই অর্থের প্রতীতি হয়। বিদ্যাকে অবধারণের জন্য পাত্রের যোগ্যতা কিংবা পাত্রের ধরন গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ তার জ্ঞান, অবস্থান এবং বুদ্ধিবৃত্তি অনুসারে তার নিজের মত করে অর্থ তৈরি করে; অর্থাৎ মেটান্যারেটিভের প্রতি আস্থাহীনতা। পূর্বনির্ধারিত বা সমাজ নির্ধারিত বা লেখক নির্ধারিত অর্থকে শিরোধার্য মনে করা আদতে যথার্থ নয়। লিওতারের মতে উত্তরাধুনিকতা হচ্ছে মেটান্যারেটিভের প্রতি অবিশ্বাস। আর যেহেতু প্রত্যেক মানুষেরই বুদ্ধি, মনন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, দার্শনিক অবস্থান ভিন্ন হতে পারে তাই তাদের সবার পক্ষে নিশ্চিতভাবে একই অর্থ উৎপাদন সম্ভব নয়। কথাগুলো ঠিক বিশ শতকেই প্রথম উচ্চারিত হচ্ছে এমন নয়। বিজ্ঞানভিক্ষুর সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যে বলা হচ্ছে ‘বাচ্যবাচকভাবঃ সম্বন্ধঃ শব্দার্থয়োঃ’, পাঠকের শক্তি বা সামর্থ্যরে ওপরে অর্থোৎপাদন ক্ষমতা নির্ভর করে। সেটা দ্বিপাক্ষিক বিষয়, এক পক্ষ এখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অধিকার রাখে না। শব্দ ও অর্থ উভয়ের মধ্যে বাচ্য-বাচক সম্বন্ধ আছে। এই বাচক বাচ্য সম্বন্ধকে পাঠ করাটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যার যেমন বোঝা-পড়ার ক্ষমতা তার পক্ষে ততটুকুই ধারণ করা সম্ভব। ধ্রুবসত্য বলে যেমন কিছু নেই, অর্থের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্টভাবে কোনোকিছু নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এভাবে শব্দের বিষয়ে, টেক্সটের বিষয়ে বা বক্তব্যের বিষয়ে কর্তার কর্তৃত্বকে নস্যাৎ করে দেয়া, এই নস্যাৎ করার সাথে সাথেই জেগে ওঠে প্রান্ত, অধিকার ফিরে পায় রোলাঁ বার্থের উত্তরাধুনিক পাঠক, কুত্রাপির টেক্সট স্বয়ং। দেরিদার there is nothing outside of the text’ কিংবা নিৎশের ‘There are no facts, only interpretations’ এই দুটি কথাকে আপাত বিপরীত মনে হলেও দেখা যাবে দুজনই আসলে কর্তাসত্তাকে অস্বীকার করছে। একজন বাইরে থেকে লেখকের কর্তৃত্ব অস্বীকার করছে, অপরজন ঘটনাকে অস্বীকার করে ব্যাখ্যাকে মান্যতা দিচ্ছে অর্থাৎ এখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা অধিপতির ক্ষমতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। নাগার্জুনের ‘শূন্যতা সপ্ততি’র প্রতিপাদ্য বিষয়, সকল অস্তিত্বশীল বস্তুই আপেক্ষিক, চরম সদর্থক বা চরম নঙর্থক কোনটিই ঠিক নয়। জৈন মতবাদের বৈশিষ্ট্য অন্য সব মতবাদের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ, তারা একান্তবাদ প্রত্যাখ্যান করে অনেকান্তবাদ সমর্থন করেন। কেন্দ্রিকতার ধারণা সন্দেহজনক। আমরা ভুল প্ররোচনায় তথাকথিত আধুনিক হয়ে উঠেছি।
কাজেই কুত্রাপির কেন্দ্রবিমুখতা আমাদের নিজস্ব জিনিস কিন্তু এর সাথে উত্তরাধুনিক ভাবনার বিরোধ নেই। তবে আধুনিকতার সাথে বৈপরীত্য আছে। কুত্রাপির চলমান জীবন্ত সত্তার কারণেই এর কেন্দ্রবিমুখ প্রবণতা, যাকে আমরা উত্তরাধুনিকতার সাথে মিলিয়ে পাঠ করতে গেলে বিশেষ কোনো সমস্যা নেই।
আদিত্য আনাম: 'কদাচিৎ কুত্রাপি' এবং 'বিকস্বর কুত্রাপি' নামে আপনার দুইটি কুত্রাপির বই আছে। কুত্রাপির আর কোন বই লিখেছেন কি?
দ্রাবিড় সৈকত: ঐ দুটি বইয়ে ৫০৪ টি কুত্রাপি আছে। এর বাইরে আমার অন্তত হাজার দেড়েক কুত্রাপি লেখা আছে। আমি নিয়মিত লিখছি, কিন্তু এই দুটি বইকে আরেকটু সময় দিতে চেয়েছি, চাইলে অনেকগুলো বই এতোদিনে করা যেতো; তবে আগামী বছর শ পাঁচেক কুত্রাপি নিয়ে ‘কুত্রাপি অবিনশ্বর’ নামে একটি বই প্রকাশের ইচ্ছা আছে। আর আমি লেখাপড়ার বাইরে সাধারণত থাকি না, কাজেই লেখা জমে আছে প্রচুর।
আদিত্য আনাম: বৈশ্বিক কবিতার প্রেক্ষাপটে কুত্রাপির এই ধারা কতটুকু স্বতন্ত্র বা সংযোজন বলে আপনি মনে করেন?
দ্রাবিড় সৈকত: বৈশ্বিক কবিতার প্রেক্ষাপট সুবিশাল, তবে আমার জানা পৃথিবীতে কবিতার ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই নতুন সংযোজন। কবিতার কোনো ফরমেটেই সম্ভাবনার এতোটা ব্যাপ্তি নেই। কুত্রাপি একটি জীবন্ত কবিতার ধারা। এমন বৈচিত্র্যময় ও বহুরৈখিক সম্ভাবনায় সমৃদ্ধ কবিতার কাঠামো এখনো আমার চোখে পড়েনি। সেখান থেকেই বলতে পারি এটি পুরোপুরি স্বতন্ত্র সংযোজন।
আদিত্য আনাম: পুরোনো ও অব্যহৃত শব্দের প্রয়োগের কারণে কুত্রাপির যে কিছুটা ভাষাগত দুর্বোধ্যতা বা জটিলতা তৈরি হয় তা কি কুত্রাপির দুর্বলতা নয়?
দ্রাবিড় সৈকত: ‘দুর্বোধ্যতা’ বা ‘জটিলতা’ শব্দ দুটিই বরং দুর্বোধ্য এবং জটিল। অনেকগুলো প্রেক্ষিতের বিচার ছাড়া কোনো ভাষা-বাক্য-শব্দকে জটিল বা দুর্বোধ্য বলা যায় না। যেমন কার কাছে জটিল বা দুর্বোধ্য? তার জানাশোনার পরিধি কেমন? তিনি ইতিহাস-দর্শন-রাজনীতি-অর্থনীতি সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখেন কি? তার মগজ তৈরির পেছনে কোন ধরনের চিন্তার উপাদান সবচেয়ে প্রভাবশালী? কোন বিষয় তিনি এড়িয়ে চলেন? তিনি কি কবিতার পাঠক না লেখক? ইত্যাদি অনেক প্রশ্নের সদুত্তর ছাড়া কোনো বিষয়ে জটিল বা দুর্বোধ্য এমন সিদ্ধান্তে আসা যাবে না।
তাছাড়া অপরিচিত কোনো শব্দ থাকলে তার ভেতর দিয়েও পাঠকের যে অনুভূতি হয় তাকে কেনো গুরুত্ব দেয়া হবে না? সেটি কি কোনো অনুভূতি নয়? টক-ঝাল-তিতাও স্বাদ, কেবল মিষ্টি তো নয়। দুর্বোধ্যতাও একধরনের বোধগম্যতা। নতুন শিল্পভাষার নতুনত্ব থাকবে, প্রথাকে অতিক্রম করেই তার পথ চলা। আমাদের অ্যাভারেজ লেখক-পাঠকের একটি সাধারণ সমস্যা আছে, তাদের দাবি হলো যেহেতু তিনি বাংলা ভাষায় কথা বলেন অতএব তিনি সবকিছু বুঝতে পারবেন, এটি খুব বালখিল্য দাবি। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা বিমূর্ত চিত্রকলা বোঝার পদ্ধতি কী? শিল্পের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিচরণের জন্য, আস্বাদনের জন্য কিছু মেধা-শ্রম-অধ্যবসায় পাঠকেরও প্রয়োজন হয়। আমাদের আরো একটি বাজে ধারণা হলো কোনোকিছু সম্ভবত সবার জন্য একইভাবে বোধগম্য হবে, এটি একটি সম্পূর্ণ অবাস্তব দাবি। বাংলা ভাষার লক্ষ লক্ষ শব্দ পাঠকের অপরিচিত, তাই বলে সেসব ভাষা ব্যবহার করা যাবে না? অব্যবহৃত ভাষার ভেতরে জ্ঞানের যেসব রত্নরাজি ছড়ানো আছে তাকে ফেলে দেবো? এটি নিঃসন্দেহে লেখকের প্রতি কিছু কূপমণ্ডূক পাঠকের কুপ্ররোচনা। পুরাতন, পরিত্যক্ত অব্যবহৃত শব্দের ব্যবহার কুত্রাপির দুর্বলতাতো নয়ই বরং এটি তার অন্যতম শক্তি। তাছাড়া কুত্রাপির আরো কিছু দিক আছে যেমনÑ যমক, অনুপ্রাস, ব্যঞ্জনা, আদি-অন্ত-মধ্যমিল বা রূপ-রস-ভাবের সাদৃশ্যগত চলন পাঠককে হাত ধরে এগিয়ে নেয় তাই সরাসরি অর্থ বোধগম্য না হলেও সাধারণ পাঠক তাকে চমৎকারভাবে গ্রহণ করতে পারে।
আদিত্য আনাম: কুত্রাপি পরিকল্পিত বক্তব্য বা ভাব থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। যতক্ষণ না কুত্রাপি লেখা শেষ হচ্ছে লেখক জানেন না কুত্রাপি শেষমেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এই অপরিকল্পিত ব্যাপারটি কবিতার জন্য কতটুকু ইতিবাচক আর কতটুকু নেতিবাচক বলে আপনি মনে করেন?
দ্রাবিড় সৈকত: আট নম্বর প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়ের প্রথম অংশ বলা হয়েছে। অপরিকল্পনা এবং ইতিবাচকতা আর নেতিবাচকতা নিয়ে বলা যায়। অপরিকল্পনা এখানে সম্পূর্ণ পরিকল্পিত, কারণ আমি যখন কুত্রাপি লিখতে বসেছি আমি জানি এর ভেতরে কি কি ঘটতে পারে; সুতরাং আমার এ বিষয়ে প্রস্তুতি আছে। ইতিবাচকতা আর নেতিবাচকতা যে কোনো নতুনের জন্য চ্যালেঞ্জ তবে কুত্রাপির ক্ষেত্রে এটি সম্ভাবনার উন্মুক্ত দুয়ার। লেখক তার ভাব বা বক্তব্যকে পাঠকের উপর, এমনকি টেক্সটের উপরও চাপিয়ে দিচ্ছেন না, পাঠককে এখানে উপভোগ করার প্ররোচনা দিচ্ছেন। সেই উপভোগ বহুমাত্রিক, এর ভাষা, শৈলী, রস ও ভাবের ঘোর পাঠকের ভেতরে ঢুকে যায়। তবে সমস্যা হলো ব্যাপারটি বোঝার ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম একটু জটিলতা তৈরি হয়। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলাতে পারলে তরতর করে সর্বত্রগামী হয়ে ওঠে পাঠকের মন। তাই কুত্রাপির ক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ইতিবাচক হয়ে উঠতে সময় লাগবে।
আদিত্য আনাম: কুত্রাপির কোন দুর্বলতা আছে কি ? যদি থাকে তাহলে সেটা কি?
দ্রাবিড় সৈকত: কুত্রাপির প্রধান দুর্বলতা হলো এটি এখনো নিরীক্ষা পর্যায় পুরোপুরি পার করেনি, কাজেই অনেক কিছুই নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে, ভবিষ্যৎ লেখকগণ তাকে পূর্ণ করে কুত্রাপিকে পূর্ণতা দিতে থাকবে। তবে আমার সন্দেহ এটি কখনো পূর্ণতা পাবে না, কারণ এর কাঠামো পূর্ণতার ধারণাকে পাশ কাটিয়ে চলে। আর কুত্রাপি বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই এটি অনেক বেশি উন্মুক্ত, কাঠামোগত দিক থেকে দুর্দান্তভাবে স্বাধীন, চলমান এবং জীবন্ত। আরেকটি দুর্বলতা হলো একে গ্রহণ করে নিতে এবং রসাস্বাদনের ক্ষেত্রে অপ্রস্তুতি। আমার ‘বিকস্বর কুত্রাপি’ গ্রন্থের শেষ কুত্রাপিটি (৫০৪) হলো:
কুত্রাপি পড়তে লাগে প্রস্তুতি
বস্, স্তুতি যদি প্রাপ্য হয় করেন;
ধরেন ফালতু চালে চরে গেলো কবিতার দিন
পড়েন পুস্তকাদি বিয়েশাদি বসিবার আগে
সুস্থ বাদী চায় আলামত
বুঝতো রাধিকায় থালা শত শত বিছিয়েই দিবে
উছতো ভাজি হোক তিতা তিনগুণ
চিনি নুন
তিনি খুন হলেও তার চাই
আরে ভাই স্বাদের বহুত্ব হলে জমে ওঠে কালা মত...
এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণের বিরাট ধৈর্য্য রাখায় কবি আদিত্য আনামকে আন্তরিক ধন্যবাদ।