লিখিত সাক্ষাৎকার
প্রশ্ন পর্ব-০৪
তমসা অরণ্য
(১) প্রশ্ন: সাগর ইসলাম: কবি, কেমন আছেন? কোনো ফরমালিটি দিয়ে শুরু না করে
আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাচ্ছি। প্রথমেই জানতে চাচ্ছি আপনার শিক্ষকতার জীবন ও মুক্তচিন্তার
বিষয়ে।
উত্তর:
তমসা অরণ্য- নিজেকে
ভালো রাখার চেষ্টাটা নিজেই করি তাই সাধারণত ভালো থাকি। তবে জুলাই থেকে ‘দেশের মতন’ আছি, অর্থাৎ দেশ যখন যেমন হচ্ছে আমিও তেমন থাকছি।
একসময়ে শিক্ষকতার সঙ্গে ‘ছিলাম’। আর আমার শিক্ষকতা জীবন অম্ল-মধুর স্মৃতিতে পরিপূর্ণ।
যত যা মধুর তার সমস্তের কারণ আমার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা এবং যতটা অম্ল তার
কারণ আমাদের দেশের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থব প্রশাসন ও শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার
সঙ্গে জড়িত অমেরুদণ্ডী স্বার্থবাজ অসৎ প্রাণীরা। আমি আমার শিক্ষার্থীদের কখনো শিক্ষা
দিতে যাইনি, শ্রেণিকক্ষে দাঁড়িয়ে বা হাঁটতে হাঁটতে জানা-শোনা-চেনা-বোঝার প্রক্রিয়াটা
ভাগাভাগি করে নিয়েছি কেবল।
মুক্তচিন্তার বিষয়ে যদি বলতে চাই,
তাহলে আমি তো নিজেকে মুক্ত চিন্তকই মনে করি। কিন্তু সৎ আত্মজিজ্ঞাসার ছাঁকন প্রক্রিয়ার
ভেতর দিয়ে সেই চিন্তার সমস্ত রস নিষ্কাশন করে দেখলে প্রশ্ন জাগে- ঠিক কতটা মুক্তচিন্তার
অধিকারী আমি? কারণ আমার জন্মপরিবেশ, বেড়ে ওঠার পারিপার্শ্বিকতা, দেশীয় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক
ও ধর্মীয় পরিবেশ, নানান ধরনের ট্যাবু, পারিবারিক-একাডেমিক ও কর্মক্ষেত্রে শিক্ষা ও
অভিজ্ঞতা ইত্যাদি তো আমার চিন্তাবৃক্ষের শেকড় ও ডালপালা। তাই না? এসবের দ্বারা তো আমি
অবচেতনে হলেও প্রভাবিত। ফলে নিজেকে মুক্তচিন্তার অধিকারী বলা মাত্র সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত
হয়ে ভেতরে ‘ঠিক কতটা’-র খচখচ যে তৈরি করে এই সত্যও জানিয়ে রাখলাম। তবে
একজন ভিন্ন মতাবলম্বীর সঙ্গে আমি দ্বিমত থাকতে পারি, সেটা নিয়ে নিরুত্তাপ বা উত্তপ্ত
তর্কও হতে পারে এবং যৌক্তিকভাবে আমি ভুল প্রমাণিত হলে আমি তাও মেনে নিতে রাজি আছি কিন্তু
তার সঙ্গে সহমতে না এসেও সহাবস্থানে থাকার মতন মুক্তচিন্তা আমার রয়েছে বলেই আমি জানি।
এটা আমার এতদিন ধরে যাপন করে আসা জীবনের থেকে উপলব্ধ ও আপ্ত করা সচেতন চর্চা বলতে পারেন।
সমাজের একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত জীবনে যা ইচ্ছা তাই চর্চা করতে পারে। তার জীবনে
হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার নেই এবং যতক্ষণ না সে তার চর্চিত সেসব বিষয় আমার ওপরে চাপিয়ে
দিতে আসছে, আমি তো কোনো সমস্যা দেখি না। কারণ নিজের জীবনে হয়তো আমি নিজ থেকেই নিজের
বিবেকের তাড়নায় নিজের জন্য কিছু নিয়মনীতি ও বিধি-নিষেধের সীমা বেঁধে নিয়েছি, কিন্তু
তার মানে তো এই নয় যে সবাই আমার জীবনাদর্শ মতন চলতে বাধ্য। আমার কাছে মুক্তচিন্তা মানে
এই। অর্থাৎ যথাসম্ভব কোনো কিছু দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজস্ব উপলব্দধি ও অভিজ্ঞতালব্ধ
চিন্তাচেতনাকে কাজে লাগিয়ে এক বা একাধিক বিষয় বা মতকে গ্রহণ করতে পারার সক্ষমতা। গ্রহণ
করা অর্থাৎ সহনশীলতা আর নিজ জীবনে তার প্রয়োগ ঘটানোর মধ্যে কিন্তু পার্থক্য রয়েছে।
(২) প্রশ্ন: সাগর ইসলাম: আপনার প্রথম
গল্পের বই ‘নাই সন্তানের জননী’-তে জনসাধারণের জীবনমুখী বিষয়বস্তু প্রাধান্য পেতে দেখেছি। ফিলোসফিক্যাল
টার্ন নিয়ে এমন ক্লাসিক্যাল গল্প যে, বিশেষত সকল শ্রেণির পাঠক সোজা কথা সকল শ্রেণির
জনমতে পৌঁছাবার চূড়ান্ত সুন্দর কৌশল আপনার গল্পে পাওয়া যায়। আপনার গল্প যেন আমাদের
চারপাশের জনসাধারণের জীবনের কথা। কীভাবে এত সুন্দর করে সে সব জীবনকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে
ভাষার রূপে পরিপূর্ণতা আনেন? আপনি বা আপনার এমন সুন্দর উপস্থাপন থ্ট বা চিন্তার উৎসই
বা কোথায়?
উত্তর: তমসা
অরণ্য: কোনো কোনো নাটক বা সিনেমার
ডিসক্লাইমারে দেখবেন লেখা থাকে “সব চরিত্র কাল্পনিক”, কিন্তু সাধারণত আমার প্রায় প্রতিটা গল্পের কোনো না কোনো অথবা একাধিক
চরিত্রও বাহ্যিকভাবে কিংবা ভেতরগত দিক থেকে বাস্তব। এদের কারও কারও সঙ্গে হয়তো আমার
দেখা হয়েছে এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, হাঁটাচলা কিংবা বাসে-রিক্সায় চলাফেরার মধ্যেই। দেখাটা
হয়তো কাছ থেকে কিংবা দূরত্ব রেখেই। দূরবীণের এপিঠ-ওপিঠ করে দেখার মতন আরকী! কিন্তু
কাকে কোন প্লটে ফেলবো, কীভাবে আনবো, পরিবেশ-পরিস্থিতি ভেদে কার মুখে কী ভাষা দেবো সেটুকুতেই
মূল কারিজমা। এটা আসলে সব লেখকের মধ্যেই থাকে, নইলে একজন অলেখক আর লেখকের পার্থক্য
আপনি কীভাবে করবেন? তাই না? এই রেসিপিটা আমার মনে হয় লেখকভেদে ভিন্ন হয়, আর তা খুঁজে
বের করার দায়িত্ব মূলত গঠনমূলক সমালোচকের। আমি একজন লেখক এবং আমার মূল কাজ লিখে যাওয়া,
আর একজন সমালোচকের দায়িত্ব লেখকের রেসিপি বা লিখন-কৌশল আবিষ্কার করার। আমি চাই যার
যার দায়িত্ব সেই পালন করুক। তাই এ বিষয়ে আমার বিশেষ কিছু বলার নাই। আর আপনি যে বললেন
“সুন্দর করে উপস্থাপনের” প্রসঙ্গ সেটা আমি আদতে কতটা করতে পারি তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ও
অতৃপ্তি রয়েছে।
আবারও বলছি “সুন্দর উপস্থাপন” ব্যাপারটি নিয়ে আমি সন্দিহান, কারণ আমার অনেক চিন্তা
আপাত অর্থে অসুন্দরও বটে। চিন্তার কি আদতে সুন্দর-অসুন্দর হয়? কারণ আমি যতটুকু বুঝি
চিন্তা জগতের কোনো সীমাই তো নাই। সেখানে আপনি চাইলেই মুক্ত বিচরণ করতে পারেন, আপাত
অসামাজিক ও অসুন্দর বিষয় নিয়েও অনায়াসে ভাবতে পারেন। তবে হ্যাঁ উপস্থাপনভঙ্গির ব্যাপারে
যখন বলছেন, সেটার সুন্দর-অসুন্দর হতেই পারে। সৃষ্টির ক্ষেত্রে কিংবা লেখালেখির ক্ষেত্রে
কোনো কিছু উপস্থাপনের সময়ে আমার যে নিজস্ব চিন্তাভঙ্গি বা দৃষ্টিভঙ্গি তার মূল উৎস
সম্ভবত আমি নিজেকে প্রকৃতির সন্তান মনে করি এবং এই সমগ্র প্রকৃতি আমার মূল ধর্ম। ফলে
খুব সহজেই কোনো কিছুকে বিচার-বিশ্লেষণের সময় আমার মাথায় ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে সেটাকে
দেখার একটা প্রক্রিয়া কাজ করে। এক্সপেরিমেন্টাল মানসিকতা বলতে পারেন। একজন মানুষের
তাৎক্ষণিক সততার পেছনের নিরুপায় অবস্থা বা অসৎ উদ্দেশ্যটাকে বুঝতে পেরে তা উপস্থাপন
করার রহস্যও কিন্তু সেই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে দেখার সক্ষমতা থেকেই এসেছে।
(৩) প্রশ্ন: সাগর ইসলাম: আপনি কত
বছর যাবৎ বাংলা সাহিত্যের সাথে আছেন? গল্পের পাশাপাশি আপনি কি কবিতা, উপন্যাস, গবেষণামূলক
কোনো কাজ করছেন বা সাহিত্যের অন্যান্য শাখা নিয়ে কাজ করছেন? ২০২৫ সালে অমর একুশে বই
মেলায় আপনার কী ধরনের বই আমরা পাঠক মহলে পেতে পারি? আপনি কি একজন লেখিকার পাশাপাশি
মানুষ জীবন লিড করছেন নাকি মানুষ জীবনের পাশাপাশি লেখিকা জীবন লিড করছেন?
উত্তর:
তমসা অরণ্য: যখন
থেকে আমাকে ছড়া কেটে কেটে বা গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো হত, তখন থেকেই তো আমি বাংলা সাহিত্যের
সঙ্গে আছি। তবে লেখালেখি অর্থে যে অংশগ্রহণ তা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকাকালে বাবার কাছে
মুখে মুখে ছড়া কেটে প্রশ্ন করার সময় থেকে, যখন জানতে চাইতাম-
“প্রাইমারি হলে কেন হাইমারি হয় না?
গরু কেন গরু তারে গাধা কেন কয় না?”
এটাই সম্ভবত মনে করতে পারার মতন আমার
সর্বপ্রথম লেখা। অর্থাৎ অন্য অনেকের মতোই আমারও লেখালেখির হাতেখড়িটা শৈশবেই। তবে নিজস্বতা
তৈরির পথে সিরিয়াস লেখালেখির সঙ্গে জড়িত আরও পরে। সেটা কম করে হলেও দেড় যুগের মতন সময়কাল
ধরে।
আমি মূলত আদ্যোপান্ত কবি। অন্তত নিজেকে
তাই মনে করি। আমার লেখালেখির কেন্দ্রে কবিতা। শুরুও হয়েছিল কবিতা দিয়েই। যে কজন চেনেন,
তারা চেনেন কবিতার মধ্য দিয়েই। বাদবাকি যা এসেছে তা কবিতাকে আবর্ত করেই। ফলে হ্যাঁ,
আমি গল্পের পাশাপাশি কবিতা নিয়ে কাজ করেছি। গীতিকবিতা বা গানও লিখি। অনেক আগে একবার
একটা মুক্তিযুদ্ধের আরেকটা প্রেমের উপন্যাস নিয়ে কাজ করার চেষ্টা শুরু করে ব্যর্থ হয়েছিলাম,
তখন মনে হয়েছিল উপন্যাসের জন্য আমি একদমই তৈরি নই। তবে ভবিষ্যতে নাটক বা উপন্যাস নিয়ে
কাজ করার ইচ্ছা আছে, যার গন্ধ বিচক্ষণ পাঠক মাত্রই আমার গল্পের গায়ে পাওয়ার কথা। বাকি
রইলো গবেষণামূলক কাজ। সেটা ১০-১১ বছর আগে জীবনানন্দের কথাসাহিত্যের একটা বিশেষ দিক
নিয়ে করেছিলাম যেটা আরও সমৃদ্ধ আকারে করে ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে বই আকারে প্রকাশের
ইচ্ছা রাখি। তাছাড়া নজরুলের “ব্যথার দান” নিয়ে একটা
কাজ শুরু করেছিলাম যার ধারাবাহিকতা রাখা হয়নি। আরও কিছু আইডিয়া ছিল যা একদমই বাস্তবায়ন
করা সম্ভব হয়নি। খেয়ালি মন, ছোটাছুটির অস্থির জীবন আর স্বেচ্ছাচারিতার জন্য আমার পক্ষে
সাহিত্য নিয়ে গবেষণামূলক কিছু করা একটু কঠিনই বটে। ফলে কিছু করতে শুরু করলেও সেটা পরবর্তী
সময়ে মন মতো না হওয়ায় বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়ার ঘটনা আমার জন্য বিরল নয়। তাই গবেষণামূলক
আর কিছু করার পরিকল্পনা আমার একদমই নেই।
২০২৫ সালে যদি প্রকাশ করি তবে কবিতার
বই প্রকাশ্যে আসার সম্ভাবনা প্রবল। তবে সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার তীব্র
তাগিদ ভেতরে তৈরি হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতার কারণে সেটায় এখনো যেহেতু হাত দিতে পারিনি
তাই সেটা অন্তত এইবারের মেলায় আসার সম্ভাবনা নেই। গল্পের বইয়ের একটা চাহিদা তৈরি হয়েছিল,
কিন্তু প্রথম বইয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার মতন পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে উঠতে না পারায় এবং তাড়াহুড়া
করে মানসম্মত কিছু আনতে পারবো না বলে সেই আশাও রাখছি না। তবে এর বাইরে গল্পের ক্ষেত্রে
অন্য একটা ভিন্নধর্মী বই আনার চমক শেষে গিয়ে থাকলেও থাকতে পারে। এই সম্ভাবনাটা এখনো
একদম নাই করে দেওয়া যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কিছু আইডিয়া জেনারেট হচ্ছে, কিন্তু
সেগুলোকে লিখে ওঠা বা গুছিয়ে ওঠার মতন যথেষ্ট কাজ আমি করতে পারছি না।
আগেই বলেছি আমি মূলত প্রকৃতির সন্তান
এবং সেটা মানুষ রূপেই। ফলে আমার জীবনযাপনটাও মূলত সত্যিকারের মানুষ হওয়ার চেষ্টাতেই।
এর পাশাপাশি আদতে লেখক জীবন লিড করছি। তবে সামাজিক মানুষ অরণ্যের চেয়ে অসামাজিক লেখক
তমসা অধিক সৎ বলে আমার মনে হয়। কারণ সমাজ আপনাকে বেড়ি পরিয়ে দিতে সক্ষম, আর লেখালেখি
আপনাকে সেটা ভাঙ্গতে এমপাওয়ারড করে।
(৪) প্রশ্ন: সাগর ইসলাম: বর্তমান
সাহিত্যিকরা একজন আরেকজনের মতবাদ নিয়ে নানারকম আলোচনা/সমালোচনায় ব্যস্ত। কখনো কখনো
বা বেশিরভাগই দেখা যায় তারা সবসময়ই তাদের সৃষ্টি অর্থাৎ বই নিয়ে আলোচনা/সমালোচনা না
করে ব্যক্তি আক্রমণই বেশি করেন, মূল যে বিষয়ে আলোচনা/সমালোচনা হওয়া দরকার তা না হয়ে
হয়ে যায় ব্যক্তিগত বা দলগত আক্রমণ- এসব বিষয় আপনি কীভাবে দেখেন এবং আপনার এসব বিষয়ে
মতামত কী?
উত্তর:
তমসা অরণ্য: বর্তমান
সাহিত্যিকদের জন্য বইমেলাকেন্দ্রিক বাজার দখলের লড়াই অনেকটা যেন রুটি-রুজির প্রশ্ন।
যদিও অধিকাংশ সাহিত্যিকই টিকে থাকার তাগিদে অন্য কোনো পেশায় আছেন, তবুও কথাটা আপনি
মিথ্যা বা ভুল বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। দেখবেন, আমাদের প্রকাশনা শিল্প গালভরা একটা
শিল্প তকমা নিয়ে বসে আছে, কিন্তু তা না হতে পেরেছে শিল্প আর না করতে পেরেছে ব্যবসা।
ফলে প্রকাশনা শিল্পের ব্যর্থতার উল্লেখযোগ্য রকমের ঝাঁজ গিয়ে পড়েছে আমাদের সাহিত্যিক
মহলে। সেখানে সুস্থ ও গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে তাই কাউয়া ক্যাঁচালই বেশি। আগুনে
ঘি ঢালার মতন আবার আছে ফেসবুক ভাইরালি জ্বর, যে যত নেগেটিভ মার্কেটিং এর মধ্য দিয়ে
আলোচনায় থাকতে পারে তার বই আবার ততই বিকায় বেশি- এরকমও দেখা যায়। ফলে ব্যক্তিগত আক্রমণ
টনিকের মতন কাজ করে একটা বিতর্ক বা কুতর্ক ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এগুলো তো শিল্পের অংশ
হতে পারে না, ব্যবসার অংশ। যদিও সেই ব্যবসায় আবার দেখবেন ব্যবসার প্রকৃত নীতিগুলোও
অনুপস্থিত। মহাজ্বালা! এই জন্যই কিন্তু বললাম প্রকাশনা ন্যূনতম ব্যবসাও হয়ে উঠতে পারে
নাই। আসলে আপনার এই প্রশ্নের উত্তরে যা যা বললাম তা নিয়ে বিশদ আলোচনার ব্যাপার আছে,
নইলে অনেক পক্ষই আমাকে ভুল বুঝতে পারে। মানে প্রত্যেকটা লাইন ব্যাখ্যাযোগ্য, কিন্তু
আজ আর এত বড়ো আলোচনায় আমি যাব না।
(৫) প্রশ্ন: সাগর ইসলাম: আপনি আপনার
জগতে পুরো পৃথিবীটাকে কেমন দেখতে চান? সে জগতের মানুষগুলো চিন্তা, চেতনা, চলাফেরা ও
সৃষ্টিতে কী রকম হবে?
উত্তর:
তমসা অরণ্য: আমার
মাথার ভেতরে যে আলাদা আদর্শ জগতের ছবি আমি আঁকি তা প্রচণ্ড প্রতিযোগিতামূলক হলেও কখনো
মানসিক শান্তি ও স্থিতি হারায় না। আপনি মুক্ত চিন্তা বিষয়ে জানতে চাওয়ায় যা যা বলেছি
আমার সেই কথাগুলোর রিপিটেশনই ঘটবে আমার মতন করে ভাবা আমার জগতের মানুষগুলোর চিন্তাচেতনা
ও চলাফেরা প্রসঙ্গে। কারণ তারা হবে যতটুকু সম্ভব আঞ্চলিক নির্যাসকে বাঁচিয়ে রাখা বিশ্ব
নাগরিক, যদি মহাবিশ্বের নাগরিকও হয়- আমি অবাক হবো না। এগুলো এত বিশদ আলোচনার বিষয়,
মানে আপনার করা কিছু কিছু প্রশ্নের এক একটার উত্তরের জন্যই এক আলাপ বা বসা বা আড্ডা
প্রয়োজন। কিন্তু আমাকে যেহেতু অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে, তাই আমি চেষ্টা
করছি যতটা পারা যায় অল্পে বলতে। তারপরও আমাদের আলাপ দীর্ঘই হয়ে যাচ্ছে, এর কারণ প্রশ্নগুলো
বিস্তারিত উত্তর দাবি করে।
যাহোক, বাকি রইলো তারা সৃষ্টিতে কেমন
হবে। আমার মনে হয় শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির ধারায় আপনি আলাদা করে সংজ্ঞায় বা কাঠামোতে
তাদের সৃষ্টিকে আলাদা আলাদা শাখায় ভাগ করতে পারবেন না। এখনও যেমন গল্প, উপন্যাস, নাটক,
কবিতা ইত্যাদি নানা ভাগে ভাগ করতে পারছেন সেটা আমার ভাবনা জগতের মানুষদের মধ্যে নেই।
তারা তাদের চিন্তার একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহের মধ্যে থেকে সেটার উপযোগী ভাব-ভাষা-কাঠামো
নির্বাচন তো করে নেবে কিন্তু সেটা পাঠ করতে করতে আপনার বাস্তব পৃথিবীবাদী মগজ অনুযায়ী
সেটাকে কখনো মনে হবে উপন্যাস, কখনো নাটক, কখনো গল্প,কখনো কাব্য কিংবা মহাকাব্য। কিন্তু
সেটাকে একক কোনো কাঠামোতে ফেলে বলতে পারবেন না যে, এটা উপন্যাসই বা কবিতাই। মানে আপনি
পূর্বপরিকল্পিত কোনো চিন্তা দ্বারা সেটাকে সাহিত্যশাখার কোনো সুনির্দিষ্ট ফর্মে ফেলতে
পারবেন না, তবে এর যে ভাব-ভাষার গভীরতা তাতে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতে থাকতে ‘এটি কোন জনরার সৃষ্টি’ এ রকম কিছু ভাবতেও ভুলে যাবেন।
(৬) প্রশ্ন: সাগর ইসলাম: ফ্যাসিস্ট
সরকার পতনে ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদের যে ভূমিকা তা আপনি বর্তমান সময়ে কীভাবে দেখেন?
উত্তর:
তমসা অরণ্য: খুবই
ইতিবাচকভাবে দেখি। কারণ ছাত্রত্ব তো আদতে আজীবনের, কিন্তু সেই গন্ধ ও জোশ আপনার-আমার
গা থেকে উধাও। তাই আপনি-আমি (আপনি-আমি বলতে জনতার কথা বুঝিয়েছি) যে দাবি মনে মনে রেখেও
এত বছর ধরে রাজপথে নামবো কী নামবো না করতে করতে আর পূর্বাপর ভাবতে ভাবতে কাটিয়ে দিয়েছি
তা ছাত্ররা করে দেখিয়েছে। এর বাইরে আমরা সাহিত্যিকরা তো কেউ কেউ প্রতিনিয়ত বা কখনো
কখনো নীরবে আমাদের প্রতিবাদগুলো কাগজে-কলমে লিখেই গিয়েছি। কিন্তু সেটা কি আদৌ উল্লেখযোগ্য
বা তেমন কার্যকর কিছু ছিল?
(৭) প্রশ্ন: সাগর ইসলাম: বর্তমান
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেভাবে দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হচ্ছেন তাতে বৈশ্বিক পৃথিবীতে
এর কোনো প্রভাব ভবিষ্যতে পড়বে কি পড়বে না- কী মনে হয় আপনার? দেশে বর্তমানে ছাত্রদের
অবস্থান সব জায়গায় দেখা যাচ্ছে এসবের সুফল বা কুফলইবা আমরা সাধারণ জনগণ কতটা ভোগ করতে
পারি সামনের দিকে?
উত্তর:
তমসা অরণ্য: অবশ্যই
পড়বে। বিশ্বে বাংলাদেশ এখনো অনেক দেশের নাগরিকদের কাছে তাদের জ্ঞানস্বল্পতা ও আমাদের
প্রচার ব্যর্থতাতেই হয়তো ভৌগোলিকভাবে ভারতের একটা প্রদেশ হিসেবে ভুল পরিচয় নিয়ে বসে
আছে। কিন্তু বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ একটা গেইম চেইঞ্জার ফ্যাক্ট। সেটা কেউ স্বীকার
না করলেও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও বিশ্বরাজনীতিতে জায়ান্ট বা পরাশক্তি দেশগুলোর রাজনৈতিক
ক্ষমতাসীনরা মনে মনে হলেও স্বীকার করে। ভারতের পাশাপাশি আমেরিকা, চীন, রাশিয়া- আপনার
কি মনে হয় না আমাদের সরকারের কোনো কোনো সিদ্ধান্তে এদের অনেককে নতুন করে ছক কষতে হবে?
আমার জানা-বোঝার জ্ঞানভান্ডার অতি সীমিত, রাজনীতি-অর্থনীতি খুব বুঝি ব্যাপারটা এমনও
না। কিন্তু যেটুকু না বুঝলে নয়, সেটুকুর জ্ঞানে তো আমার এমনই মনে হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে এই যে ছাত্রদের অবস্থান
সব জায়গায় দেখা যাচ্ছে এটা প্রাথমিকভাবে কয়েক বছর বাংলাদেশকে বেশ ভোগাবে। এখন এই যে
ভোগাবে বললাম তা শুনেই কেউ কেউ তেড়ে আসবে, কিন্তু কথাটার গভীরতা ধরার চেষ্টাও করবে
না। সুফল এখন তেমন পাওয়া যাবে না, সেটা পেতে অপেক্ষা করতে হবে। তবে কুফল ভোগ শুরু হয়ে
গিয়েছে। কেন বললাম বাংলাদেশকে ভোগাবে? কাদের ভোগাবে? কীভাবে ভোগাবে? এই প্রশ্ন করতে
হবে তেড়ে আসার আগে। তার আগে বলি ছাত্রত্ব একটা বিরাট পাওয়ার। কিন্তু সব ক্ষমতা সবখানে
খাটাতে যেতে নাই, তাতে ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনাই বাড়ে। সেটাই ঘটছে বলেই আপনার
এই প্রশ্নের অবতারণা, নইলে আপনার মনে এই প্রশ্নের উদয় হত না। কারণ দ্বিধাই প্রশ্নের
জন্ম দেয়।
ছাত্রদের অবস্থান আসলে সবখানে নাই,
তারা কেবল জরুরি প্রয়োজনেই যেখানে যেখানে যখন যখন পৌঁছে যাওয়া দরকার ত্রাতার মতন এগিয়ে
যাচ্ছে। কিন্তু বাদবাকি যেখানেই যখন-তখন বা সর্বক্ষণ আপনি যাদের অবস্থান দেখছেন, ভালো
করে খোঁজ নিয়ে দেখেন তারা আদতে ছাত্র নয় ছাত্রদের নাম ভাঙ্গিয়ে খাচ্ছে; আবার কেউ কেউ
ছাত্র হয়েও ছাত্র নয়। কারণ ছাত্রদের যে স্পিরিট যে নীতি-নৈতিকতা যে নিঃস্বার্থ ও ত্যাগী
মনোভাব আন্দোলনে আমরা অতীতে দেখে এসেছি বা এইবারেও দেখেছি তা তাদের মধ্যে অনুপস্থিত।
তারা দল-মত-বয়স-শ্রেণি এমনকি ছাত্রত্ব নির্বিশেষেও আদতে সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী,
স্বার্থপর, নৈরাজ্যবাদী ও অন্যায়কারী। এদের কোনো ছাত্র-অছাত্র ভেদ হয় না। দেশ একটা
অস্থিতিশীল অবস্থা পার করছে, যতদিন স্থিতিশীল না হচ্ছে ততদিন ভোগাটা আন্দোলনের বাই
প্রোডাক্ট।
এখন আসেন, কাদের ভোগাবে প্রসঙ্গে-
সত্যিকারের ছাত্ররা শঠ, অসৎ, অন্যায়কারীদের জন্য বিভীষিকা সুতরাং তাদের ভোগাবে। আর
ছাত্র লেবাসধারীরা তাদের স্বার্থ বাগাতে যে কারো জন্য যেকোনো সময়ে যেকোনো জায়গায় ভোগান্তি
হয়ে দেখা দিবে। আর বাকি রইলো কীভাবে ভোগাবে- সেটা প্রকৃত ছাত্ররা ভোগাবে অন্যায়কারীদের
প্রতিহত করে দিয়ে, আর ছাত্র লেবাসধারীরা ভোগাবে দুষ্কৃতিকারীদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত
হয়ে বা চাঁদাবাজী-দখলদারী-সন্ত্রাসী কাজ করে। এতে তো জনসাধারণকেই ভুগতে হবে তাই না?
কেন বললাম প্রাথমিকভাবে কয়েক বছর
বাংলাদেশকে ভোগাবে, কারণ এই জুলাইয়ে যারা আন্দোলনকারী প্রকৃত ছাত্র ছিল আগামী কয়েক
বছর তাদের তৈরি হওয়ার সময়। এই তৈরি হওয়ার সময়টুকুতে বাকি ছাত্র লেবাসধারীরা যতটা পারে
সুবিধা করে নেবে, কিন্তু প্রকৃত ছাত্ররা যখন তৈরি হয়ে যাবে তখন সরকারি ক্ষমতায় এখন
যেমন দু-চারজন তেমন নয় বরং অধিকাংশ জায়গাতেই বুদ্ধিবৃত্তিক ও সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দেবে,
ফলে কয়েক বছর পর ছাত্র লেবাসধারীদের এইসব উচ্চবাচ্য নীরব হয়ে আসবে বলে আমার ধারণা।
যে মব কালচারকে ঘিরে আপনার আতঙ্ক বা আশঙ্কা থেকে আপনার এই প্রশ্ন দুটির জন্ম হয়েছে,
আশা করছি সেই মব কালচার দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তবে সেটা নির্ভর করছে প্রকৃত ছাত্রদের
সচেতন কর্মকাণ্ড ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার ওপরে।
(৮) প্রশ্ন: সাগর ইসলাম: বাক স্বাধীনতার
নামে যে মানবিক ট্যাবু আমাদের সমগ্র সাধারণ জীবনে ভর করে আছে রাজনৈতিক বা উদ্দেশ্যকেন্দ্রিক
কারণে- তা থেকে আমরা অতি সাধারণেরা কবে মুক্তি পেতে পারি বা মুক্তি পেতে করণীয় কী?
আদৌ কি আমরা কখনো প্রাণ খুলে নিজের কথা বলতে পারবো রাষ্ট্রের যেকোনো অবস্থানে যেকোনো
বিষয়ে?
উত্তর:
তমসা অরণ্য: বাক
স্বাধীনতা তো বাই ডিফল্ট মানুষের থাকার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে ছিল না, এখন তৈরি হচ্ছে
আবার। তবে সেই তৈরি হবার পথটা যদি আবার ইউটার্ন নিয়ে নেয়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক কিছু
হতে পারে না। অতি সাধারণদের মুক্তি পাওয়ার জন্য উপায় একটাই- বলতে শুরু করা বা বলা থামিয়ে
না দেওয়া। আর করণীয় হচ্ছে- রাজনৈতিক সচেতনতা ও প্রয়োজনে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ
এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। আর আপনার “কবে মুক্তি পেতে পারির” ব্যাপ্তিটা নির্ভর করছে উপায় ও করণীয়র কার্যকারিতার ওপরে। তার মানে
কি আপনি ধরে নিচ্ছেন যে, বাক স্বাধীনতা এখনো আসে নাই? বা এলেও তা অচিরেই মিলিয়ে যাবে?
তেমন মনে হলে বলবো, বাক স্বাধীনতা আমার মনে হচ্ছে এসেছে। যদিও আপনার কথা কারও পছন্দ
না হলে তীব্র সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন আপনি
বিরুদ্ধ মতটি বলতে পারছেন অন্তত। অবশ্য পট-পরিবর্তন ঘটলে এবং সরকারের বদল হয়ে পুরনো
ভূতেরাই ঘুরে-ফিরে ক্ষমতায় এলে তা কতটা জারি থাকবে এ নিয়ে সন্দেহ করা যেতেই পারে, কারণ
আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা আমাদেরকে সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরাতে বলে দেয়, কারণ আমরা ঘরপোড়া
গরু।
তারপরেও বলবো, দেখেন, এত অবদমনের
পরেও কিন্তু ৩৬শে জুলাই বা ৫ই আগস্ট এসেছে। তাই আমরা কখনো প্রাণ খুলে রাষ্ট্রের যেকোনো
অবস্থানে যেকোনো বিষয়ে নিজের কথা বলতে পারবো কিনা সেই রকম অনিশ্চয়তা আবারও গেড়ে বসলে
সময়েই আবার তার রগ কেটে দেওয়া হবে। অন্তত এই গণঅভ্যুত্থানে জনতা ছাত্রদের কাছ থেকে
সেটাই শিখে নিয়েছে।
(৯) প্রশ্ন: সাগর ইসলাম: চিন্তার
স্বাধীনতা পেতে মূলত আগে দরকার কথা বলতে পারার স্বাধীনতা পাওয়া- এই কথা বলার স্বাধীনতা
আমরা কেনো পাচ্ছি না, এতে কি ধর্মীয় কোনো সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম আছে আমাদের? নাকি পুরোটাই
এক শ্রেণির মানুষ নিয়ন্ত্রণ করছেন?
উত্তর:
তমসা অরণ্য: “চিন্তার স্বাধীনতা পেতে মূলত আগে দরকার কথা বলতে পারার স্বাধীনতা পাওয়া”- এই বক্তব্যের সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ দ্বিমত আছে। বলতে পারেন ব্যাপারটাকে
আমি একটু ঘুরিয়ে দেখি, কিন্তু সেটা ব্যাখ্যাযোগ্য হওয়ায় আমি আপনার লাইন ধরে এগিয়েই
উত্তর দিচ্ছি। কথা বলার স্বাধীনতা আমরা যদি না পেয়ে থাকি সেটা আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক
ব্যর্থতা। তার মানে আমরা আমাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নই এবং বারবার এটাকে হতে দিচ্ছি।
আমাদের সংবিধান সম্পর্কে কি আমাদের প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে স্কুল পর্যায় থেকেই?
আমরা কি সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদ সম্পর্কে জ্ঞাত? যদি এসবের উত্তর “না” হয়ে থাকে, তাহলে কেন পাচ্ছি না তার প্রাথমিক উত্তর
এটাই। ধর্মীয় যে সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম আপনি ধারণা করছেন তা প্রশ্ন করতে না পারা থেকে
উদ্ভুত মূলত, সেটা কথা বলতে না পারার নয়। সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে আরকী। আসলে এটা পুরোপুরিই
এক শ্রেণির মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সেটা তারাই যারা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার
কেন্দ্রে অবস্থান করছে। সেখানে ধর্ম-রাজনীতি-অর্থনীতি এগুলো কেবলই ব্যবহারের বিষয়।
আপনাকে বলার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হলে আপনার প্রতিবাদও যে ভাষা পাবে! তখন আপনি প্রতিটা
ক্ষেত্রের অন্যায্যতা নিয়ে কথা বলবেন, জনমত গড়বেন এবং তাদের হুকুমাতের প্রাসাদ গুঁড়িয়ে
দেবেন। এটা তারা কেন হতে দেবে?
(১০) প্রশ্ন: সাগর ইসলাম: সাহিত্যের
উত্তরাধুনিকতা বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন? উত্তরাধুনিকতা বিষয়ইটিই বা কী- যদি বিস্তারিত
বলতেন!
উত্তর:
তমসা অরণ্য:সাহিত্যের
উত্তরাধুনিকতা নিয়ে কথা বলতে গেলে আপনার পরের প্রশ্নটির উত্তর আগে দিতে হবে। উত্তরাধুনিকতা
হচ্ছে আধুনিকতার প্রতিক্রিয়ায় একটা বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। অনেকে এটাকে আধুনিকতাবাদ
বিরোধী মতাদর্শও বলেন।
মতবাদ ও মতাদর্শ জগতে আমার জানা মতে
উত্তরাধুনিকতাবাদকে এখনো পর্যন্ত ঐক্যমতের ভিত্তিতে কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন দেওয়া
সম্ভব হয়নি। অনেকেই অনেকভাবে এটাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন।
আর সেসব সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার পরিধি এতটাই বিস্তৃত যে সেটা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করলে আমাদের
আড্ডাটি একঘেঁয়ে হয়ে পড়বে এবং পাঠক বা শ্রোতা পড়তে বা শুনতে গিয়ে মনোযোগ বা ধৈর্য কোনোটিই
ধরে রাখতে পারবেন না। আমি সেটা চাই না বলেই এর আগের প্রশ্নগুলোর উত্তরও যতটা সম্ভব
স্বল্প পরিসরে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
তো, যেখানে ছিলাম আবার ফিরে যাই-
আধুনিকতাবাদ হলো আধিপত্যবাদী পুঁজিবাদকেন্দ্রিক, শ্রেণিচেতনাসমৃদ্ধ ও সার্বজনীন সত্যকে
চূড়ান্ত মেনে আসা এক মতবাদ যা কেন্দ্রীকরণের ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করে। সেটার প্রতিক্রিয়াতেই
কিন্তু গড়ে উঠেছিল উত্তরাধুনিকতাবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। যেটা আসলে আধুনিকতার পরবর্তী
পর্যায়, যেটা আধুনিক থেকে উত্তরোত্তর আরও আধুনিক হয়েছে বা হচ্ছে। আর আমি বিরোধিতা না
বলে প্রতিক্রিয়া বলছি কারণ এটা কেন্দ্রীকরণ নয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলে বা
কেন্দ্র-প্রান্তের ব্যাপারটাই নাই করে দিচ্ছে, শ্রেণি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং ব্যক্তির
চৈতন্য বা চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলে, যেখানে ধ্রুব সত্য বলে কিছু নেই। মানে আমি উত্তরাধুনিকতা
বলতে বুঝছি আধুনিকতা থেকে উত্তরোত্তর আরও আধুনিক হওয়াকে।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে আধুনিকতা যদি
আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি হয়, তবে উত্তরাধুনিকতা অনাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ আধুনিকতাবাদ যেকোনো কিছুর অবস্থান
নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে অর্থাৎ আদর্শ সেট করে দিচ্ছে, কিন্তু উত্তরাধুনিকতা বলছে- না,
সেই অবস্থানকে প্রশ্ন করো, সন্দেহ করো, চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দাও। আধুনিকতা
নির্দিষ্ট ফর্মে বাঁধছে তো উত্তরাধুনিকতা ফর্মকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। আধুনিকতা প্রশ্ন সুনির্দিষ্ট
করছে, তো উত্তরাধুনিকতা আরও আরও প্রশ্ন তুলতে বলছে সন্দেহ করতে উৎসাহিত করছে। আধুনিকতা
চরম কর্তৃত্বে আস্থা রাখতে বলছে, তো উত্তরাধুনিকতা বলছে বিকল্পহীনতায় অনাস্থার কথা।
আধুনিকতা বিশ্বায়নের নাম করে অতীত-ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করছে, তো উত্তরাধুনিকতা প্রয়োজনে
অতীত-ঐতিহ্যের অনেক কিছুর এসেন্স গ্রহণেও আগ্রহী। অর্থাৎ একটা পর্যায় থেকে সেটা আরেকটা
উন্নত পর্যায়ে আমাদেরকে উন্নীত করছে।
সাহিত্যে উত্তরাধুনিকতা কিন্তু বিশ
শতকের মাঝামাঝি থেকে চলে এসেছে। বাংলা এবং বাংলাদেশের সাহিত্যেও সেই হাওয়া এসে পড়েছিল।
দেখবেন, একসময় আমরা ধরতাম যে এই এই এই উপাদানগুলো থাকলে এটাকে একটা কবিতা ধরা হবে।
কিন্তু পরে দেখা যাচ্ছে, কবিতার সেই প্রচলিত আভরণগুলো খসিয়ে নিয়ে তার গায়ে এমন এমন
সব উপাদান চড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, কবিতাকে আর আগের সেই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়েই বা সেই আগের
মানদণ্ডে বিবেচনা করে বিচার করা যাচ্ছে না। এখন দেখা যাচ্ছে কবিরা ভাষাকে নিয়ে অনেক
বেশি খেলছে। ল্যাংগুয়েজ গেইম নিয়ে কথা বলে গেছেন লিওতার। আপনি লাইনের পর লাইন বা এক
লাইনের নিচে নিচে থাকা লাইন দিয়ে যে চিরায়ত কবিতার রূপ দেখে এসেছেন তার বদলে স্থান
নিয়েছে প্যারাগ্রাফের ফর্মে থাকা পাশাপাশি লাইনের কবিতা কিংবা দেখা যাচ্ছে বাজারের
ফর্দের আকারে যেটা লিখিত হচ্ছে ওটাও নাকি কবিতা। একটা সময়ে পাশ্চাত্য ধারার আদলে যে
উপন্যাস রচিত হত সেই পশ্চিমা ধারাকে আদর্শ ধরে আমরা একটা উপন্যাসকে বিবেচনা করতাম।
এখন সেই আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করে দেশীয় রীতির মিশেলে প্রাচ্য ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ
উপন্যাস লেখার চিন্তাভাবনা হচ্ছে। এগুলো কেন হচ্ছে বা কেন এরকম ভাবা হচ্ছে? এর পেছনেও
কাজ করছে সাহিত্যিকদের উত্তরাধুনিক ভাবনাচিন্তা। কারণ উত্তরাধুনিক চিন্তাভাবনার একটা
শর্ত হচ্ছে এক্সপেরিমেন্টাল মনোভঙ্গি।
আরেকভাবে বললে উত্তরাধুনিকতা রিয়েল
আর রেপ্লিকা বা ফেইক এসবের মধ্যকার যে দেয়াল সেগুলোকে নাই করে দেয়। শুধু তাই না ধীরে
ধীরে দেখবেন বিভিন্ন সাহিত্য শাখার মধ্যকার যে সীমা সেটাও নাই হয়ে গিয়েছে। যদিও অলরেডি
অস্পষ্ট হতে শুরু করেছে। আমাদের আধুনিক মন হয়তো রবীন্দ্রনাথের গানকে পবিত্র ধরে নিয়ে
একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে নিয়েছে, কিন্তু আমার উত্তরাধুনিক চিন্তা হয়তো ১২-১৪ বছর
আগে আমাদের একসময়ের ব্যান্ড সংগীতশিল্পী মাকসুদের বিটিভিতে প্রচারিত রিমেক করা রবীন্দ্র
সংগীত বা ভারতের রোদ্দুর রায় নামের যে ব্যক্তিটি “যেতে যেতে
পথে পূর্ণিমা রাতে চাঁদ উঠেছিল গগণে” গানটিকে যেভাবে উপস্থাপন করলেন সেটাকে নিয়ে ভাবতে
বাধ্য করে, সেটাকে স্বাগত না জানালেও একদম ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে না; বরং বিবেচনায় রাখছে।
অর্ণবের গাওয়া রবীন্দ্র সংগীতের ধরন বা সংগীত আয়োজন নিয়ে আলাদা করে বললাম না, কারণ
এটা মানুষ গ্রহণ করে নিয়েছে এবং আমার জানামতে বিতর্কের জন্ম দেয়নি। কিন্তু আমি যে দুটো
উদাহরণ হিসেবে টানলাম, দুটোই কিন্তু বিতর্কিত হয়েছিল।
রোলাঁ বার্থ “লেখকের মৃত্যু” প্রসঙ্গে বলেছিলেন। একটা কবিতা বা গল্প লেখার পর
লেখকের অস্তিত্ব আর সক্রিয় থাকছে না, তার পয়েন্ট অফ ভিউয়ের চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে এক
একজন পাঠকের ইন্টারপ্রিটেশান। হারুকি মুরাকামির একটা লেখা পড়তে গিয়ে হয়তো আঞ্চলিক একটা
আবহ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে আমার মস্তিষ্কে এবং আমি আমার দেশের সমকালীন কোনো ইস্যুর সঙ্গে সেটার
সাদৃশ্য মিলিয়ে নিচ্ছি। অথচ আমি কিন্তু জানি না কী ভেবে মুরাকামি লেখাটি লিখেছিলেন।
এরকম দশ দেশের দশজন পাঠকের পাঠে অথবা একই দেশের দশজনের পাঠে হয়তো মুরাকামির লেখাটির
অর্থ পালটে যাচ্ছে।
আবার সেই লিওতারের প্রসঙ্গে ফিরতে
হয় যে, উত্তরাধুনিকতা হচ্ছে গ্রান্ড ন্যারেটিভ থেকে ফ্রাগমেন্টেড ন্যারেটিভের দিকে
অগ্রসর হওয়া। সমাজের সেট করে দেওয়া কারণ, সত্য, উন্নতি ইত্যাদি বিষয়ক অখন্ড বয়ান সংক্রান্ত
ডিলিউশান ভেঙ্গে দৈনন্দিন জীবনে তৈরি হওয়া খন্ড খন্ড বয়ানকে ধারণ করা। অর্থাৎ মহান
আখ্যান থেকে ক্ষুদ্র উপাখ্যানের দিকে যাত্রা। এভাবে দেখা যাচ্ছে, স্টেরিওটাইপ যত ব্যাপার
আছে উত্তরাধুনিকতা সেগুলোকে ভেঙ্গে দিচ্ছে।
মূল কথা হচ্ছে উত্তরাধুনিকতা বলেন
বা যেকোনো মতবাদ বা মতাদর্শের কথা বলেন সেগুলোর তো কিছু চিহ্নিত প্রবণতা থাকে, তাই
না? উত্তরাধুনিক প্রবণতাগুলোর অনেকগুলোই চিহ্নিত করা তো গিয়েছে যেমন একটু আগে আধুনিকতার
প্রতিক্রিয়ায় যে দিকগুলোর কথা বললাম, আর সেগুলোকে সচেতনে বা অসচেতনে বা অবচেতনে মাথায়
রেখে যখন একটা সাহিত্য রচিত হচ্ছে কিংবা সেগুলোকে ধরে যখন কোনো সাহিত্যকে সমালোচনা
বা বিচার-বিবেচনা করা হচ্ছে, তখন আসলে সেই সাহিত্যকে আমরা উত্তরাধুনিক বলছি।
তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বলবো- সাহিত্যকে
তার স্বতঃস্ফূর্ত গতিতে তো চলতে দেওয়া উচিত, তবে পাশ্চাত্যের আধিপত্য বা সেট করে দেওয়া
ন্যারেটিভকে ভেঙ্গে প্রাচ্যের (আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে বাংলা বা বাংলাদেশের সাহিত্যের)যে
মূল সৌন্দর্য ও নিজস্বতার নির্যাস সেটাতে ফিরে যেতে,এই বয়ে চলা স্বতঃস্ফূর্ত গতিকে
চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে যদি গতির স্বাভাবিকতা কিছুটা বিঘ্নিতও হয় সেটাকে আমি ইতিবাচকভাবেই
দেখবো। কারণ প্রতিনিয়ত ভাঙ্গচুর বা এক্সপেরিমেন্ট ব্যাপারটা সমস্যাসংকুল হলেও বেশ উপভোগ্য।
আর সাহিত্য সমালোচনার প্রয়োজনে একটা সাহিত্যকে নানান মতবাদ বা মতাদর্শিক দিক দিয়ে বিবেচনা
করা যেতেই পারে, কিন্তু একটা সাহিত্য সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় সেটা যে খুব ম্যাটার করতে
হবে তাও নয়। এটা অবশ্যই ব্যক্তিগত অভিমত।
যাহোক, আমার মনে হয় আমি যথেষ্ট বিস্তারিতভাবেই
আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছি। যদিও সংক্ষিপ্ততাই আমার লক্ষ্য ছিল, কিন্তু প্রশ্নের
ব্যাপকতা সেই অবস্থান থেকে আমাকে বারবার বিচ্যুত করে ফেলেছে। এজন্য আমি শ্রোতা বা পাঠকদের
কাছে অনুতপ্ত। আর হরকরা প্রকাশনের শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক শুভ উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডের জন্য
শুভ কামনা রইলো। ধন্যবাদ!
// সমাপ্ত //