কবিতা বিষয়ক বাহাস: প্রথম পর্ব
আদিত্য আনাম: এই বইমেলায় তোমার একটি কবিতার বই এসেছে, নাম 'পাথরের খিলখিল হাসি'; নামটা সুন্দর, তবুও টেক্সটের সাথে এই নামের তাৎপর্য কী?
ইয়ার খান: নামটা ইচ্ছে করেই নেওয়া। বিষয়ভিত্তিক কাজে হাত দেওয়ার মতো। এই টেক্সটার ভেতর অর্থাৎ পাথরের খিলখিল হাসি দিয়ে জগতের সবকিছু পাথরের দৃষ্টিতে দেখেছি; জীবন কী কী কাঠিন্য দশায় যেতে পারে কিবা হতে পারে কতটা কোমল, তার একাংশ চেষ্টা হতে পারে বইটি। আমার দেখার বাইরে হয়তো পাঠক এরচেয়ে বেশী কিছু আবিষ্কার করতে পারে।
আদিত্য আনাম : কেন কবিতা লেখো?
ইয়ার খান: কেন কবিতা লিখি! প্রশ্নটার চূড়ান্ত উপলব্ধি ধারণ করি কীনা! তবু মনে হয় আমার সমস্ত সম্ভাবনা কবিতার ভেতরেই। অন্য কিছু পারি না৷ সাবলীল জীবনের জয়-পরাজয়ও খুব একটা নেই; কবিতায় কিছু একটা আছে আমার; শুধু এইটুকু উপলব্ধি আসে আমি কবি, আমার কাজ মানুষকে তার হৃদয়ের দিকে ধাবিত করা; এমনকি নিজেকেও।
আদিত্য আনাম: কবিতা না-পড়েও তো মানুষ দিব্যি সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে। আমাদের এই যান্ত্রিক ও ব্যস্ততম দৈনিন্দন জীবনে কবিতার আবশ্যিকতা কতটুকু?
ইয়ার খান: কবিতা না-পড়েও বেঁচে থাকা যায় কিন্তু সেই বেঁচে থাকা নিয়ে সন্দেহ আছে, সেটা আদৌ বেঁচে থাকা বলে কীনা!
আদিত্য আনাম: প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কবি এবং কবিতাকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। তবে কি কবি এবং কবিতা একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য ক্ষতিকর? প্লেটোর এই সিদ্ধান্তকে একজন কবি হিসেবে তুমি কীভাবে কাউন্টার করবে? কিংবা কোন কোন যুক্তিতে তা মেনে নিবে?
ইয়ার খান: কবিতা না পড়লে দিন দুনিয়ার কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু এও সত্য কবিতা ছাড়া দিন-দুনিয়াও এক্সিস্ট করবে না। সমস্ত নন্দনের ভেতর কবিতা আছে। আই মিন, কবিতা শুধু শব্দবন্ধ খেলার ভেতর সীমাবদ্ধ নয়; কামার যখন কাঁচা লোহা পিটিয়ে তাকে মরণঘাতী করে তোলে তখনও সেটা কবিতা হয়ে ওঠে। হাজার হাজার বছর মানুষের ইতিহাসে নানা উপকরণে নানা আবিষ্কারে কবিতা টিকে আছে। বোধ করি আগামীতেও থাকবে।
আদিত্য আনাম: তোমারর কবিতা লেখায় কে বেশি তাড়না দেয় হৃদয় নাকি মস্তিষ্ক?
ইয়ার খান: হৃদয়, মস্তিষ্কও!
আচ্ছা আনাম ভাই৷ এই বইমেলায় আপনারও তো একটি কবিতার বই এসেছে, নাম 'বিজিতের বাইবেল'; আপনার বইয়ের নামটাও সুন্দর, তবুও টেক্সটের সাথে এই নামের তাৎপর্য কী?
আদিত্য আনাম: বিজিত মানে পরাজিত আর বাইবেলকে তো সবাই চেনে/জানে একটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এখানে বাইবেল বলতে শুধু বাইবেল না, বরং সমস্ত ধর্মের পবিত্রগ্রন্থ বা পবিত্রতা মিন করতেই ওই নামটা নেওয়া। বিজিতের বাইবেলের কবিতাগুলো মূলত একজন পরাজিত মানুষের দুঃখ, নিয়তি, বিষাদ, বেদনা, ক্রোধ ও কৈফতগুলোর একটা সংকলন যা তার কাছে পবিত্র বাইবেলের মতোনই পবিত্র। ভিতরের টেক্সট মূলত বিজিতের বাইবেল ছাড়া অন্যকোনো নামে সেই মাধুর্যতা তৈরি করতে বা আবেদন ধরে রাখতে অক্ষম। টেক্সটের জন্য এই নামটাই অনিবার্য।
ইয়ার খান: আপনি কেন কবিতা লেখেন?
আদিত্য আনাম: পৃথিবীতে এইটাই আমার একমাত্র কাজ যা আমি হৃদয় ও মস্তিষ্ককে সমানভাবে ধ্যানস্থ করে সম্পাদন করতে পারি। এইটা অনেকটা শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই— যা ছাড়া বেঁচে থাকা অনিশ্চিত। আর হ্যাঁ, কেন লিখি সেইটার মোস্ট অ্যাপ্রোপ্রিয়েট অ্যানসারটা সম্ভবত এইটা যা আমি কয়েকদিন আগে একটা ইন্টারভিউয়ে বলেছিলাম আমার কাব্য-ভাবনায় আর সেটা হলো— আমার ভাবনা-ই কবিতা হয়ে ওঠে কিংবা শেষতক কবিতা-ই আমার ভাবনা হয়ে যায়। কারণ আমি কবিতার কাছে সমর্পিত আর কবিতাও আমার কাছে...! এটাকে কি বলা যেতে পারে? ধর্ম? প্রেম? নেশা? মায়া? বিভ্রম নাকি বিশ্বাস? জানি না, তবে ব্যক্তি (শরীর) আমি আর লেখক (চিন্তা) আমির মাঝখানে প্রবাহিত অনুভূতির আশ্চর্য এক আগুনের নদী সাঁতরে পার হয়ে আমি যার কাছে আশ্রয় পেতে যাই কিংবা যে আমার কাছে আশ্রয় পেতে আসে তিনিই কবিতা, তিনিই শিল্পলোকের এক অনিবার্য অধিপতি; পৃথিবীতে আমি কেবল তার-ই প্রতিনিধিত্ব করার প্রয়াস করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
ইয়ার খান: কবিতা না-পড়েও তো মানুষ দিব্যি সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে। আমাদের এই যান্ত্রিক ও ব্যস্ততম দৈনিন্দন জীবনে কবিতার আবশ্যিকতা কতটুকু?
আদিত্য আনাম: কবিতা ছাড়া বেঁচে থাকা যায়। হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল যেমন বেঁচে আছে তেমনই। মানুষ তো শুধু বেঁচে থাকে না, সে জীবনকে যাপন করে, তার যাপনের সাথে অন্যান্য প্রাণির যাপনের যে পার্থক্য আছে কবিতা সেই পার্থক্যটা মোটাদাগে তৈরি করে। কবিতাহীন জীবন আর কবিতাময় জীবন কখনোই একই মর্যাদায় যাপিত হয় না।
ইয়ার খান: প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কবি এবং কবিতাকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। তবে কি কবি এবং কবিতা একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য ক্ষতিকর? প্লেটোর এই সিদ্ধান্তকে একজন কবি হিসেবে তুমি কীভাবে কাউন্টার করবে? কিংবা কোন কোন যুক্তিতে তা মেনে নিবে?
আদিত্য আনাম: প্লেটো কেন যে তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কবি/কবিতাকে নিষিদ্ধ করেছিলেন সেইটা নিয়ে আমি মাঝেমাঝে ভাবি। সম্ভবত তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র কেবল আজকের এই কর্পোরেট রোবটদের জন্যই পরিকল্পনা করেছিলেন। সফলও হয়েছেন। নয়ত কবি/কবিতা নিষিদ্ধ করবে কেন! কবিতা তো শিল্প, কবিতা তো নতুন চিন্তা, কবিতা তো নতুন দর্শন, কবিতা তো ভাবনার বিষয়-আশয়, কবিতা তো জীবনের রঙ! তো! এইসমস্ত ব্যাপারগুলোকে নিষিদ্ধ করার অর্থ হলো মূর্খতাযুক্ত, চিন্তাভাবনাহীন, শ্রীহীন, যান্ত্রিক কর্মময় ও নির্বোধ সমাজকেই নির্দেশ করে। তাই বলা যায় কবি/কবিতাহীন যে রাষ্ট্র সেটা কখনোই আদর্শ রাষ্ট্র হতে পারে না।
ইয়ার খান: আপনার কবিতা লেখায় কে বেশি তাড়না দেয় হৃদয় নাকি মস্তিষ্ক?
আদিত্য আনাম: দুটোই। কারণ কখনো কখনো হৃদয় ব্যাকূল হয়ে ওঠে কথা বলার জন্য আবার কখনো কখনো চিন্তা স্বয়ং এসে দাঁড়িয়ে যায়। ভাবাতে বাঁধ্য করে, লেখার প্ররোচনা দেয়। তবে দুটোর ভিতরে তুলনামূলক হৃদয়ই বেশি তাড়না দেয়, কার সে আমার সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি থাকে।