সাগর ইসলামের কাব্যগ্রন্থ "দোজখের পারফিউম " পাঠ আলোচনা
রুপ,রস,গন্ধ অথবা মায়াবিদ্যা মন্ত্রের শরীর প্রাসঙ্গিক,
দু-মুখো ঢেউ গুড়িয়ে জলপ্রাণের গল্পে, আজ শরাব হাতে সারস পাঠক বসেছে কিঞ্চিৎ আলোর দোলাচলে। আড্ডার বিষয়ানুবদ্ধতা আমাদের পর্দা সরে চিত্রায়ণ হচ্ছে পিচ্ছিল"দোজখের পারফিউম।
পার্সি বিশী শেলী'র কবিতা প্রাসঙ্গিক একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে যেখানে তিনি বলেছেন" কবি একটি দোয়েল, যে অন্ধকারে বসে মিষ্টি সুরে আমোদিত করে তুলে নিজেরই একাকিত্ব। এযাবৎকালে যতজন কবি ও কবিতার সাথে পরিচিত হয়েছি তারা প্রত্যেকেই প্রায় পার্সি শেলী'র উক্তি সামঞ্জস্যপুর্ণ, সেদিক থেকে কবি সাগর ইসলাম স্রোতের বিপরীতে শাসন করে চলেছে কবিতার সৌন্দর্য; তিনি কবিতায় একাকিত্বকে তুলে না এনে তুলে এনেছেন শৈল্পিক আহাজারি - যে আহাজারি আনন্দের শরীর জড়িয়ে আছে তিক্ত বিহার! সব'ই আছে তবুও অপূর্ণ মহাকা।
জল,স্থল বা পাথরে চাষাবাদের গল্প অহরহ,কিন্তু শূন্যে ভাসমান ফুলবাগান অথবা কাটাবন- কেবল নতুন গল্প'ই নয় বরং নতুন সৃজন; তেমনই অনাকাঙ্ক্ষিত কবিতায়নে মাতাল কবি সাগর ইসলাম।
সাগর ইসলাম সমন্ধে বলতে গেলে ও বুঝতে হলে আপনাকে অবশ্যই সুকান্ত ভট্টাচার্যের "রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে -রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে” এই বিখ্যাত লাইনগুলো পড়তেই হবে ' কারণ এই বিখ্যাত উক্তিতে সুকান্ত ভট্টাচার্য তার অবস্থান থেকে ভবিষ্যৎ এঁকেছিলেন নিঁখুত তুলির আঁচড়ে! হয়তো কবি সাগর ইসলাম বা তেমন'ই কতেক কবিদের কবিতার বিবর্তনবাদ নিয়ে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন! এমন একটি সময় গন্ধকেও স্পর্শে নিয়ে আসবে শব্দের সৌন্দর্যে যৌবনবতী কবিগণ।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভবিষ্যৎ কল্পনার বাস্ততা ফুটে উঠেছে কবি সাগর ইসলামের " দোজখের পারফিউম" কাব্যগ্রন্থে
চলুন প্রমাণপত্রে কয়েকটি কবিতা পাঠ করাযাকঃ-
*বীঘা বীঘা অন্ধকার হেঁটে যাচ্ছে চোখের সমাধি দস্যু দেখে-
কারো শরীর প্রেমিকার কপাল থেকে হস্তান্তর হচ্ছে বাঘের পেটে কি অদ্ভুত!
জীবন বন হওয়ায় একটি বাঘের ভেতর দুটি কবর দৌড়ায়
আর আমরা
বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি চলমান কয়েকটি কবরের ঝিরিঝিরে সিনেমা।
*মানুষ কিনতে বাজারে গেছিলাম। বাড়িতে এসে ব্যাগ খুলে দেখি শুধু চরিত্রটা'ই এসেছে।
*বেশ্যা শুধু কাপড় খুলে, খদ্দের খুলে চরিত্র।
*কবিতা হচ্ছে সদ্য মা হওয়া নারীর উল্লাস, বুক খামচানো সন্তানের গায়ে লাগতে দেয়নি পিরিয়ডের দাঁগ।
*খড়ার কথা মনে হলে কেবল বেরে যায় গাছের আন্দোলন -
আর বনের কথা মনে হলে
মনেহয় -
বাঘের কান্নায় ভেসে যাবে হরিণ ও ঘাসের গল্পো।
পূর্বেই বলেছিলাম কবি সাগর ইসলাম অন্যান্য কবিদের থেকে ভিন্নধর্মী শব্দশাস্ত্রজ্ঞ শাসক,তার শরীর থেকে চোখের অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব- তার লাগামহীন বেলেল্লাপনার প্রকাশেন্দ্রীয় নিবন্ধন করে চলে বায়বীয় গল্প।
"অনুরূপঃ
বীঘা বীঘা অন্ধকার হেঁটে যাচ্ছে চোখের সমাধি দস্যু দেখে-
কারো শরীর প্রেমিকার কপাল থেকে হস্তান্তর হচ্ছে বাঘের পেটে কি অদ্ভুত!
জীবন বন হওয়ায় একটি বাঘের ভেতর দুটি কবর দৌড়ায়
আর আমরা
বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি চলমান কয়েকটি কবরের ঝিরিঝিরে সিনেমা।
-কবি সাগর ইসলাম এই কবিতায় নিঁখুত কৌশলে শব্দহীন আঘাত করেছে মহীরুহের বিপনি দেওয়ালে- যে দেয়াল জুড়ে কবি খুঁজে পেয়েছে হাজার বছরে পুরাতাত্ত্বিক হত্যাচিত্র।
আল্লামা ইকবাল বলেছেন "কবিরা সমাজ দেহের চক্ষু, বাগানের মুক্ত পাখি এবং সত্যের দর্পন।"
কবি সাগর ইসলামের ভাবপ্রবনতা,দৃষ্টিশূলতা,শব্দশৈলী'ই প্রমাণ রাখে যে আল্লামা ইকবাল এর মহা উক্তি ও কবি সাগর ইসলাম একে অপরের ব্যঞ্জনাবৃত্তি।
কবি সাগর ইসলাম একজন দুরন্বয় শব্দবাজিকর গোত্রের
এককপদে উঁৎ-ধিরাজ। তার কবিতার শরীর, শব্দশৈলী, ভাষারীতি, প্রকাশতরু বিস্তৃত হয়েছে -রাস্ট্র,সমাজ,পরিবার,পরিবেশ, প্রকৃতির বাস্তবিক চিত্রে।
তার প্রতিটি কবিতা ভিন্ন রণাঙ্গন অথবা প্রেমালিঙ্গণ প্রকাশ পায় যেমন কবি তার অন্য একটি কবিতায় বলেছেনঃ-
"চিন্তার নারিকেল গাছে
কথার ঠাটা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে প্রচণ্ড মগজের ডাব
রোদ কিংবা লাল বিকেল,
ঘাট সিংহাসনে নেই কোন মানুষ উৎসব
তবুও একটি গোপালভাঁড় মন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরকারি পাখি,
তাকে বসতে দাও।
বাতাসের শারীরিক ব্যায়াম
কোমল হয়ে নামুক পাখির দেশে।"
-এই কবিতায় কবির প্রথাগত ক্ষুধাকে বড়শিগাঁথায় প্রতিবাদ ছুঁড়ে মেরেছে জলহীন পুকুরে। এখানে কবি তার সারল্য প্রকাশ করেছে অন্যান্য কবিদের মতোই- অন্যান্য কবিদের মতো কেন বললাম সেটা বুঝতে হলে ' কবি আবুল হাসান এর এর কবিতার এই লাইন গুলো জানতে হবে যেখানে কবি বলেছেন-
“ঝিনুক নীরবে সহো,/ঝিনুক
নীরবে সহো,/ঝিনুক নীরবে সহে যাও,
ভিতরে বিষের থলি/ মুখ বুঝে মুক্তা ফলাও।”
কবি আবুল হাসান কবিরুহের ফরজ-পাঠ অনেকটাই স্পষ্ট করেছে। কবিরা মূলত তাদের ভেতরিন জমাট বাঁধা পঁচা,দুর্গন্ধযুক্ত অপ্রকাশিত কথাগুলোকে শব্দাস্রে রুপান্তরিত করে - অতঃপর; প্রবল শক্তিশেল প্রক্রিয়ায় ছুঁড়ে মারে কবিতায়।
অনেকটা বায়বীয় গ্যাসে রুপান্তরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গ অথবা জমাট বাধা কথায় সৃজিত হওয়া ঐশ্বরিক কবিতাস্র- যা জীবনচিত্রের সার্কেলিজম অথবা;অদৃশ্য শক্তির ক্ষমতায়ন প্রকল্প। কবিদের এই নিগুঢ় শব্দতত্ত্ব বুঝাতে গিয়ে কবি অরবিন্দ চক্রবর্তী আস্ত এক কাব্যগ্রন্থ'ই প্রকাশ করেছিলেন যে কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ নাম ছিলো "ভেতরিন লুকিয়ে হলে সঙ্গে" এই সংক্ষিপ্ত প্রচ্ছদনামেই কবি বোঝাতে চেয়েছে কবিদের চিন্তাধারা সাধারণ মানুষের থেকে ভিন্ন ও উন্নত।
কবিদের মন ও জ্ঞান চোখ প্রত্যেকটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়কে নিয়ে যায় পোস্টমর্টেম টেবিলে-অজস্র কাটা-ছেঁড়ার করে যে রিপোর্ট উপস্থিত হয় সেটা ভেতরেই লালিত প্রেম অথবা দ্রোহ যা কবির শরীরের সাথে বেড়ে উঠে চামড়ার ন্যায়।
লম্বা একটা সময় জলরেনু জমাট বেঁধে সৃষ্টি হয় উত্তপ্ত শব্দকামান- যাকে সাধারণ চোখ ও জ্ঞানে আমরা কবিতা হিসেবে জানি। কবিদের একেকটি কবিতার প্রলয়ঙ্কারী ভয়াবহতা বুঝাতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন-
"গনমানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য কবিতা অস্ত্রস্বরুপ।
কাজী নজরুল ইসলামের এই একটি লাইন'ই আপনাকে কবিতা নিয়ে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে বাধ্য করবে পাঠকের সারিতে। বিদ্রোহী কবির এই উক্তিমতে আপনি পাঠক নিশ্চিত হলে ! কবিতার ধারালো সৌন্দর্যের অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা কবিকে পড়ার পথ সুগম্ভীর হবে- যেমন কবি চাচ্ছে আপনাকে তারই মতো পাঠ করাতে। কবি সাগর ইসলাম সফল তার চিন্তাফসল পাঠ-চাষীদের মগজে গেঁথে দিতে পারলে, নিঃসন্দেহে কবি ও পাঠকের এই যোগসিদ্ধি কবিতাঙ্গনে জোয়ার আসবে কল্যানের।
যেহেতু কবিদের এক এবং একমাত্র অস্র কবিতা,
সেহেতু যুদ্ধাঙ্গনে কবিদের কবিতাস্র' ব্যবহারই স্বাভাবিক। কবি আইনের এই সুযোগটিই নিয়েছে কবি সাগর ইসলাম তার " দোজখের পারফিউম " কাব্যগ্রন্থে।
যদিও কবি সাগর ইসলামের কবিতা নিয়ে আমার কিঞ্চিৎ মন-পোড়ার রয়েছে" কবির অদৃশ্য বলয় ছাড়িয়ে তার আত্মচিৎকার যা কবিতায় ঢুকতেই বেরিয়ে আনে শিশিরস্নাত সন্ধ্যায় যা বিরহের ডামাডোল হয়ে উঠে নিস্তব্ধ পাঠে। সেক্ষেত্রে কবি শহীদ কাদরী'র মতো বলতেই হয়-
জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমে,
সোনালী পিচ্ছিল পেট আমাকে উগড়ে দিলো যেন।
যেহেতু কবি সাগর ইসলামকে প্রথাগত কবিতন্ত্রের বিপক্ষীয় আচরণ ভাবি - তার ভেতরিন অগ্নিবাণ ঘায়েল মন্ত্রপাঠ স্বাভাবিক, তাই সারল্য না থাকাই শ্রেয়।
কারণ সাগর ইসলাম বরাবরই পাঠকের ধ্যানতন্ত্র; ধ্যান ভঙ্গ কবির বিপরীত ক্রিয়া ভাবায় কবির এই সারল্যের জায়গাটি আরেকটু স্পষ্ট হতে হলে
বন্ধুবর আরেকজন কবি "রিগ্যান এসকান্দর এর কবিতার বিখ্যাত একটি লাইন এখানে সংযুক্তি আকারে পাঠ করা যাকঃ-
"কবি উঠে চলে গেলে প্রেম উঠে চলে যায়"
আশানুরূপ পর্যটন ধরে রাখতে হলে অবশ্যই কবিতায় বিস্তারিত সময় ও ধ্যানকে গুরুত্বের জায়গায় চিন্তা করি।
আশা করি,কবি সরে না গেলে একেকটি কবিতা হয়ে উঠবে একেকটি মহাকাল।
তরিৎ বেগ পেরিয়ে উঠলে আমরা পূণরায় কবিকে পড়তে থাকি তার সারল্য তারতম্যে বিস্তারিল ছায়াপথ;
যদিও কবিগণ যা ভাবেন এবং যা প্রকাশ করে তার মধ্যবর্তী সংযোগস্থলে হিমালয় পর্বত সমমনা রহস্য থেকে যায়!
কবিদের এই দুর্বিপাক লাইফলাইন নিয়ে একটি কবিতায় বলেছিলাম
" বলতে না পারার তীব্রতা মানুষকে মৃত্যু যন্ত্রণায় ভোগায় -
অগুনিত শব্দ কণ্ঠনালী হতে কলিজায় রক্ত জমাট বেঁধেছে,
জমাট বাঁধা কালিতে পত্র লিখা যায়না বলে তোমাকে লিখতে পারিনি। "
এই কবিতায় কবিদের ভেতরিন বিষাক্ত হাহাকার আংশিক প্রকাশের চেষ্টা করেছি " কবি সাগর ইসলাম এবং তার প্রকাশিত কবিতা, শাব্দৌলিকভাবে প্রক্রিয়ায় মাইন - পুঁতে দিয়েছে পরিবেশ, প্রকৃতি, রাস্ট্র,সমাজ ও মানুষের চিন্তাপথে ।
এ পথের পাথচারীগণ অবশ্যই কবি সাগর ইসলামের শব্দকামান সমন্ধে বেশ ধারণা রাখেন অথবা অনেকেই রাখেন না। তবে ধারণা, রাখা না রাখা নিয়ে তার আক্ষেপ পাইনি বরং অনেকটা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মতোই পাঠে পাঠে পাঠক গড়ার আগ্রহ দেখেছি তার প্রায় কবিতায়-
এটা দারুণ ভালোলাগার ব্যাপার।
মানুষ যখন বলতে পারেনা তখন লিখে, যখন লিখতে শুরুকরে তখন কবি হয়ে উঠে যখন পরিপূর্ণ কবি হয়ে উঠে তখন তার চতুর্পাশ থেকে "দোজখের পারফিউম " ভেসে আসে।
কবি সাগর ইসলাম তার মেধা,শ্রম দিয়ে নিজেকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে প্রত্যহ। তার মেধা,শ্রম ও কবিতাপ্রেমের সংযুক্তি তাকে মুকুটধারী কবিতে রুপান্তরিত করবে বলে আশাকরি। কবিতার ধ্যান সমন্ধে আগ্রহীদের অবশ্যই বলবো আপনারা;
সাগর ইসলাম'কে পড়ুন তার কবিতার ন্যায়
যেমন তিনি সৃষ্টি করে চলেছে পৃথিবীর প্রাণান্তপরিচ্ছেদ। কারণ আপনি লেখক বা পাঠক যাই হোন বা হতে চান সেটা হতে গেলে আপনাকে "কবি রিচার্ড রাওয়েল এর বিখ্যাত উক্তিটি মানতে হবে;
আজকের পাঠ আলোচনার সমাপ্তি করতে চাই বিখ্যাত কবি রিচার্ড রাওয়েল এর একলাইনের একটি কবিতা দিয়ে-
* হৃদয় যার সঠিক স্থানে নেই , শত চেষ্টা করেও সে কবি হতে পারবে না।
_____________ রিচার্ড রাওয়েল।
এতোক্ষন পাঠ ও আলোচনা করছিলাম কবি সাগর ইসলাম এর "দোজখের পারফিউম " কাব্যগ্রন্থ ২০২৫ থেকে।
বইটি প্রকাশিত হয়েছে :হরকরা প্রকাশনী থেকে
বইটির প্রকাশকঃমোস্তাফিজুর রহমান খান শাহিন
প্রচ্ছদ করেছেঃ অক্ষরবিন্যাস হরকরা কম্পিউটার্স।
বইটির মূল্যঃ ২৪০ টাকা বইটি পাওয়া যাচ্ছে অনলাইন
অনলাইন পরিবেশকঃ রকমারি ডটকম /বুকস কর্নার
বইটি সংগ্রহে রাখতে পারেন।