||বাঙালি বৌ নয় বই চুরি করে||
।। বই নিয়ে খোলা-আলাপ।।
সৈয়দ মোজতবা আলীর একটা কথা আছে -'মনের চোখ বড় করার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে বই, যে যতো বই পড়ে তার মনের চোখ ততো বেশি!'
আমিও এ কথাটিতে বিরাট প্রয়োজনইবোধই মনে করি। শুধু মনের চোখ বড় করার জন্য নয় মানুষের জাগতিক জীবনের সকল দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে দরকার বই। বই ছাড়া সংসার জীবনের দুঃখ দুর্দশা থেকে পালানোর বিকল্প কোনো রাস্তা আছে বলে আমার মনে হয় না, আর থাকলেও তা রাস্তাহীন! মানুষ সামাজিক, পারিবারিক সকল দুঃখ থেকে তখনই নিজেকে সরিয়ে আলাদা রাখতে পারবে যখন সে নিজের ভেতর হাজার হাজার আলাদা জগৎ তৈরী করতে পারবে। যে জগতে কোনো সূর্যগ্রহণ নেই, চন্দ্রগ্রহণ নেই, নেই অনাবৃষ্টি বা তীব্র খড়া। সেসব জগতে চাইলেই যখন তখন নিজেকে মেরে ফেলা যায় আবার জন্মও দেয়া যায়। অথাৎ ভাবনার জগতে মানুষ নিজেই তার সৃষ্টিকর্তা, নিজেই তার পিতামাতা, নিজেই তার লালিত পালিত আদুরে সন্তান! আর এই জগৎ মানুষ তখনই সৃষ্টি করতে পারে যখন সে প্রচুর জ্ঞানে খেলাদুলা করে। জ্ঞান লাভই তার এই জগৎ সৃষ্টিখেলায় মেতে থাকার একমাত্র টাকা। আর এই জ্ঞান লাভ করা যায় একমাত্র বই পড়ে অথবা ভ্রমণ করার ভেতর দিয়ে।
বই পড়া সবার পক্ষেই সম্ভব কিন্তু ভ্রমণ করা সবার পক্ষে সম্ভব না। ভ্রমণ করতে যে অর্থের যোগান থাকতে হয় তা সবার কাছে থাকে না। ভ্রমণ করতে প্রচুর অর্থ খরচের অবস্থা থাকতে হয়। বই পড়তে সে অবস্থা বা সক্ষমতা না থাকলেও চলে। তাই জ্ঞান লাভের জন্য ভ্রমনের পথ বেছে নেয়ার চাইতে বই পড়ার পথটাই অধিকতর অর্থগত যুক্তিগত। বই পড়তে ভ্রমণ করার মতো তেমন দীর্ঘ খরচের দরকার হয় না। যে ব্যক্তি তিনবেলা খাবার পায় না সে ব্যক্তিও চাইলে অনায়সে মাসে দু'চারটি বই কেনার যোগ্যতা রাখে।
প্রিয়ার প্রেমেও জ্বর থাকে। জগত আলো থেকে কালোর দিকে যায়। বর্তমান পুরান হয়ে যায়। ভালো মানুষ খুণী হয়ে যায় কিন্তু বই কখনো নষ্ট হয় না। বইর চরিত্র সদাই সাদা সুন্দর। বস্তুত এই দৃশ্যমান পৃথিবীর সৌন্দর্যও মাপামাপি হয় যারযার জ্ঞানের বাটখাড়া দিয়ে। জেলখানার বাইরে কারো কাছে বাড়ি সুন্দর কারো কাছে পাহাড় কারো কাছে সমুদ্র। কেউ কেউ সুন্দর উপভোগ করতে চীন পাড়ি দেয় কেউ দেয় আমেরিকা। দেখা যায়, যে ব্যক্তি আমেরিকার সৌন্দর্য সম্পর্কে অবগত নয় জ্ঞানে, সে ব্যক্তি কোটিকোটি টাকার মদ খেলেও আমেরিকার জন্য এক টাকাও খরচ করতে রাজি হবেন না। যে ব্যক্তি মদের সৌন্দর্য জ্ঞানে অবগত নয় সে ব্যক্তি ভাত পানি ছাড়া কোনো সৌন্দর্য বুঝার নয়। মানুষের জ্ঞানের পরিমাণই বলে দেয় ভাত ও মদের সৌন্দর্যের পার্থক্য।
ধনী হবার জন্য দরকার টাকা। মানুষ হবার জন্য দরকার জ্ঞান। যদিও ধনীরা এ বিষয়টি খুব এড়িয়ে চলেন টাকার কুৎসিত বাস্তবতা দেখিয়ে। তাদের দৃষ্টিতে টাকাই একমাত্র জ্ঞান। যে ব্যক্তি যতো টাকায় জ্ঞানী অথাৎ অর্থবিত্তে যারা বেশি তারাই পৃথিবীর সুখ উপভোগ করার ক্ষমতা রাখে। বাকিরা রাখে কাল্পনিকতা উপভোগ করার মিথানন্দ! তাই ধনীদের মানবতাবাদী হওয়াকে আমি প্রচন্ড ভয় করি। এদের মানবতাবাদী হওয়ার পিছনে চূড়ান্ত কোনো জঘন্য উদ্দেশ্য থাকে। যে উদ্দেশ্য জঘন্য সে প্রেম কখনোই আজকে জন্মানো নব বৃক্ষপাতার মতো আধুনিক সবুজ নয়! ধনীদের ফাঁদে পরে যারা জ্ঞানের মশা তাড়ায় তাদের তো কালের মশা কামড়াবেই। ধনীদের চোখে বই পড়া তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় যতোটা গুরুত্বপূর্ণ টাকা কামানো। আর এই টাকাই কালের মশা। যা মানুষ ও পৃথিবীর কোমল সৌন্দর্য দিনদিন নষ্ট করে দিচ্ছে কৃত্রিম ফাঁদাচারে। এই কৃত্রিম ফাঁদ থেকে মুক্তির উপায় একমাত্র বই পড়া।
পৃথিবীর সকল দেশেই কমবেশি সবাই বই পড়ে। কিন্তু এখন আমার কথা হচ্ছে বাঙালিদের বই পড়া নিয়ে। বাঙালিদের বই পড়া নিয়ে বলতে গেলে একটা কথাই আসে- বাঙালিরা বই পড়ায় 'চোখ কিপ্টা মাছি'। এখন চোখ কিপ্টা মাছি বলতে আমি যা বোঝাতে চাই তা হচ্ছে, দেখার সর্বদিক ক্ষমতা থাকতেও যে না দেখার ভান ধরে থাকে তাদেরকেই বোঝানো। অর্থাৎ মাছির দেখার জন্য অনেকগুলো চোখ থাকে। একজন মানুষের চাইতে মাছির দেখার ক্ষমতা বেশি। মাছির শরীরের চারপাশে অনেকগুলো চোখ। মাছি একই সাথে পৃথিবীর সবদিকই পর্যবেক্ষন করতে পারে যা মানুষ পারে না। আর সেই মাছি যদি বলে আমি কিছুই দেখছি না তাহলে সে গ্রামের ধনবান কিপ্টার আচরণই করে দেখার জগতে৷ গ্রামের ধনবান কিপ্টা যেমন কাড়িকাড়ি টাকা, বিঘা বিঘা জমিজমা থাকতেও খোদার ত্রিশদিনই নাই-নাই করে, ঠিক তেমনই স্বভাব দেখিয়ে যায় চোখ কিপ্টা মাছি বাঙালিরা বই পড়া নিয়ে। এদের বই পড়ার কথা বললেই বলে, বাপু এতো বিলাসিতা পাবো কোথায়? তিনবেলা খাবার পাই না ঠিকমতো, সেখানে বই কিনে টাকা অপচয় করার মতো বিলাসিতা করা আমাদের জন্য পাপ। এ যেন এক ঘাটে জল বেঁধে মিথ্যানন্দ নিকৃষ্ট স্লোগান! বাঙালিরা অর্থবিত্তে অন্যান্য দেশের তুলনায় নিম্নশ্রেনীর একথা সত্য কিন্তু বই কেনার মতো টাকা বাঙালিদের থাকে না কিংবা নেই একথা গাঁজাখোরী কথা ছাড়া কিছুই না। বর্তমান বাঙালিরা অভাবে থাকলেও ভাত না খেয়ে মরার মতো অভাবে কেউ নেই। এছাড়া মধ্যবিত্ত বাঙালিরা যে পরিমান খরচ তাদের ব্যক্তিজীবনে করে থাকে এক্সটা তা যদি একটু দেখেশুনে হিসেব করা যায় তাতে দেখা যাবে একজন মধ্যবিত্ত মাসে ২/৩ হাজার টাকার বই অনায়সে কিনতে পারবেন। অথচ তারা তা করবে না। তারা বন্ধুর আড্ডায় এক সিগারেটের পাছা দিয়ে আরেকটি সিগারেট ধরাবে, বান্ধবী নিয়ে মাসে দু'চারবার রেস্টুরেন্টে যাবে, নিজের স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্য চাহিদার বেশি ব্যান্ডজাতীয় জিনিসপত্র কেনার প্রতিযোগিতায় নামবে। প্রয়োজনের বেশি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের প্রতি তাদের চাহিদাগত অভাব সবসময়ই দেখা যায় এবং সেসব নিয়েই যতো দুঃখ প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু কখনো তাদের মনে হয় না এসবের ভীড়ে বই কেনা বই পড়া ব্যক্তি জীবনে কতোটা জরুরী।
তাদের দৃষ্টিতে বই কেনা হচ্ছে বড়লোকদের কাজ। বই বড়লোকদের পন্য মধ্যবিত্তের জন্য অভিশাপ! বইয়ের পিছনে টাকা খরচ করা মানে মদের পিছনে টাকা খরচ করার চেয়েও বেশি অপরাধ তাদের চোখে। তাদের দৃষ্টিতে, মদ খেয়ে মাতাল হলে তবু সাময়িক জীবনে দীর্ঘক্ষণ আনন্দে কাটানো যায় কিন্তু একখানা বই কিনে তার পিছনে দু'চার ঘন্টা সময় ব্যয় করে পড়া মানে অযথা সময় নষ্ট করা। বই পড়ে কিছু হওয়া যায় বা পাওয়া যায় এটা তাদের কাছে একেবারেই অবিশ্বাসযোগ্য বিশ্বাস। সংসার, টাকা, সেক্স এসবেই তাদের ধ্যান, জ্ঞান, চলা। রাত থেকে দিন, দিন থেকে সপ্তাহ, সপ্তাহ থেকে মাস, মাস থেকে বছর -এসব নিয়ে ভেবে ভেবেই তারা একসময় বৃদ্ধ হয়, মারা যায়। মারা যাবার আগে দলে দলে উৎপাদন করে যায় তাদের মতো গোঁড়ায় গলদ চিন্তাবৃত্ত একদল আরো কিছু অকর্মাশূল আকান্দা বাঙলা মানুষ! অন্যদিকে, বাঙালি ধনীরা তো বই পড়াকে একরাত বস্তিতে ঘুমাবার মতো নাক ছিটকানো ঘৃণার মতো সমাদর করে। এরা বিদেশে একদিন লাক্সারি লাইফলিড করার জন্য লক্ষ-কোটি টাকা জলে দেবে তবু পাঁশচ টাকার মতো খুচরা টাকা তারা বই কেনার পিছনে ব্যয় করবে না। তারা মনে করে বই পড়ে সময় অপচয় করার চাইতে সে-ময়টুকু টাকা রোজগার আরো কীভাবে বাড়ানো যায়, কারে ঠকানো যায়, কারে নামিয়ে নিজে তরতর করে উপরে উঠা যায়। এসব জঘন্য ভাবনাতে সুন্দর মনোযোগ দেয়াই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এরা দরিদ্রকে আরো দরিদ্র করতে মনোযোগ দেবে, কালো টাকা সাদা করতে এরা ফেরেশতা গতীতে ব্যস্ত! ভাতের নয় এদের ক্ষুধা তীব্রভাবে লেগে থাকে, বিদেশে বাড়িগাড়ি সম্পদ করার। দুর্নীর্তি আর সিন্ডিকেট সমাজ প্রতিষ্ঠা করায় এরা রাতদিন চোরের মতো খাটে। এসবই তাদের দৈনন্দিন কাজ ও কালচার৷ বই পড়ে বই কিনে এসব থেকে বঞ্চিত হবার মতো রাম-ভোঁদাই এরা নয়। যদিও ধনীদের দালানে ঢুকলে দেখা যায় ডাইনিং রুমের আশেপাশে বড়সড় যেন এক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত করে রাখে। সেখানে অনেকগুলো তাকে হাজার হাজার বইয়ের সমারোহ। খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেসব বই কোনো সংগঠনের দাওয়াতে চিইফগেস্ট হয়ে উপহার হিসেবে এসব বইচাদা পেয়েছে। এছাড়া আরেক কারণেও ধনীদের ঘরে লাইব্রেরী গড়ে উঠে, তা হচ্ছে- নিজেদের অর্থলোমবিশিষ্ট কুত্তার পাশাপাশি সমাজে সৃজনশীল, জ্ঞানী এবং উচ্চ ভদ্র কালচারাল মানুষ হিসেবে শো-আপ করা। অথচ এরা কখনো বই পড়ার মতো পড়ে না, সে প্রেম তাদের ভেতর এক চিমটিও নেই, নেই সময়ও বৈকি!
ওদিকে, নিম্নবিত্তদের কথা কি বলবো। অন্যের লাথিগুতা, শোষণ, অত্যাচার,জুলুম ভোগ করতে করতেই কালের দিন চিরদিন করে ফেলেন যারা, তারা কীভাবেই বা বই পড়ার মতো মহৎ কাজে নিজেদের সংযোগ স্থাপন করবে। যদিও বা কিছুজনের বইর প্রতি প্রেম হয়, আর্থিক নিরাপত্তাহীন জীবন সে প্রেমের বিচ্ছেদ ঘটায় সচরাচর। নিম্নবিত্তের দৈনন্দিন জীবনের যে সিডিউল ও সার্ভাইভাল লাইফ তাতে তাদের বই না পড়তে পারা অন্যায় হিসেবে দেখাও লজ্জার। কারণ আমরা নিম্নবিত্তের পথ সবসময় নিম্নই করে রাখি। যাদের জীবনের নিরাপত্তা সিঁড়ি ভেঙে দেই রোজ, তাদের কাছে সভ্যতার প্রাচির দেখার লোভ না থাকাই আপাততো সন্মানের। অন্তত নিজের নৈতিক অক্ষমতাকে আড়াল রাখা যায়! ধরে নেই, নিম্নবিত্তের জীবনই একেকটা বই। বই নিজেই নিজেদের কীভাবে পড়বে!
তাহলে বাঙালিদের মধ্যে বই পড়ে কে? নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত কোনো শ্রেণীর লোকই যদি বই না পড়েন তাহলে প্রতিবছর বই মেলায় যে এতো নতুন বই বের হয় এবং এতো বেচাকেনা হয় এসব বই তাহলে কে বা কারা কিনে, কোন শ্রেনীর লোক কেনে? এতো এতো বই পড়ার পাঠক তাহলে কে বা কোন শ্রেণীর- এসব প্রশ্ন মনে এবং যুক্তিতে আসতেই পারে৷ আসাটাও বৃষ্টির রাতে ব্যাঙ ডাকার মতো স্বাভাবিক৷
বাঙালিদের ভেতর বই পড়ার একদল বড়সড় গোষ্ঠী আছে এবং তারাই বই পড়ে ও কিনে, এটা সত্যি। তবে এরা এককথায় বলতে গেলে -সাহিত্যগোষ্ঠীর লোক; অর্থাৎ সাহিত্য ম্রেণীর মানুষেরাই বই কিনে ও পড়ে। এই সাহিত্য গোষ্ঠীর মানুষকে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত কোনো শ্রেণীতেই আলাদাভাবে ভাগ করা যায় না। একদিকে যেমন এরা সবশ্রেণী হতে এক এক করে বহুসমষ্টির যোগফলে একগোষ্ঠীতে বিস্তার লাভ করে। আরেকদিকে দেখলে দেখা যায় সাহিত্যগোষ্ঠীর মানুষেরা নিজেদের মানসিকভাবে কোন নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কোনো মানুষ বলে পরিচয় দেয় না বা নিজেকে দাবী করে না। তাদের বিত্তগত কোনো সিদ্ধিলাভের লোভ নেই। সবার নেই তা ভুল। শয়তান ছাড়া পৃথিবীতে সবাই ভুল করে! এরাও করে। এদের বিত্তগত সিদ্ধিলাভের লোভ যতোটা না আছে বা থাকলেও তার বেশি লোভ থাকে সাহিত্যকালচার গোষ্ঠীতে নিজেকে অন্যের চাইতে সবসময়ই বড় করে দেখার, বড় করে রাখার। এ লোভ সাহিত্যে - পৃথিবীর আদিম রোগ। নিজেকে সাহিত্যগত জীবনে বড় করে দেখার লোভ ও চরিত্র কাল মার্কস থেকে শেক্সপিয়ার, শেক্সপিয়ার থেকে রবীন্দ্র, রবীন্দ্র থেকে নবারুণ, কাজী নজরুল, মলয়রায়, সুনীল, বঙ্কিম, শরৎ বাবু, জীবনানন্দ, হুমায়ুন আহম্মেদ, হুমায়ুন আজাদ, আবুল হাসান সবার সবার সবারই ছিল। বর্তমান প্রজন্মে যারা আছে তাদেরও আছে। ভবিষ্যতে যারা আসবে তাদেরও থাকবে! মানুষের গড়া ধর্মে তবু ঈশ্বরকে আলাদা করা যায়, কিন্তু সাহিত্যের জ্ঞান/ সাধনার কানামাছি খেলার নিজেকে বড় ভাববার খেলারু থেকে কাউকে আলাদা করা যায় না! যাই হোক বড় ছোট যেভাবেই দেখি দশকেজি ওজনের বোয়ালও মাছ পাঁচকেজি ওজনের বোয়ালও মাছ। মাছ মাছই সে বড় হোক আর ছোটো তা কখনো বাঘ ও বাঘের বাচ্চা হবার নয়। মূল কথা এই সাহিত্যগোষ্ঠীর মাছের বাচ্চারা বাঘ ও বাঘের বাচ্চা না হলেও বই পড়ুয়ার বাচ্চা। এখন বলতে পারেন যারা বই পড়ে সবাই তো লিখে না তাহলে সবাই সাহিত্যগোষ্ঠীর হয় কেমনে? হ্যাঁ যারা বই পড়ে সবাই লিখে না। কিন্তু লিখলেই কেবল সাহিত্যগোষ্ঠীর লোক হবে আর না লিখলে তা হবে না, এ ভাবনাটাও পুরোপুরি ঠিক নয়। যারা পড়ে তারা মূলত যারা লিখে তাদের চেয়ে বেশি বই ও লেখা সম্পর্কে জ্ঞান, ধ্যান, পর্যালোচনার গুণাবলী বেশি রাখে। নয়তো যারা পড়ে তারা নির্বাচন করতে পারতো না হাজার হাজার বই, লেখকের মধ্যে কার লেখা কোন দৃষ্টিকোন থেকে সর্বোচ্চ ভালো বা মন্দ। অতএব এদের দৃশ্যসত্য সাহিত্যিক না মানলেও আপনার আমার মানতে হবে এরা অদৃশ্যসত্য বিরাট সাহিত্যিক। এরাই সাহিত্যকে টিকিয়ে রেখেছে সাহিত্যের বাজারে। আর সাহিত্য টিকে থাকা মানেই কোনো লেখক টিকে থাকা, কোনো লেখক নতুন সৃষ্টি হওয়া এবং কোনো লেখক নতুন সৃষ্টি হবে! এই সাহিত্যগোষ্ঠীর লোকই একজন আরেকজনের বই কিনে বই পড়ে বই নিয়ে কথা বলে। যারা বই কিনে তাদের অনেকেই এবংকি লেখকরাও পাঠক বলে জানে। কিন্তু এরা জানে না, বই পড়া মানেই পাঠক, সে বই লেখকই পড়ুন বা অন্য যে কেউ-ই পড়ুক। এখানে আমি পাঠকদের পাঠক বলে ছোটো করে দেখতে অস্বস্তিবোধ করি৷ বিকজ সাহিত্যিক আর পাঠক শব্দ দুটি যখন আলাদাভাবে অর্থ প্রকাশ করে তখন তাদের সন্মানও আলাদা হয়ে যায়। এক প্রকার বড় ছোট ভেদাভেদ দ্বন্দ্বই সেখানে হেসে উঠে বেশি। আমি এ হাসিকে প্রাণ দিতে চাই না। পাঠকদেরও আমি সাহিত্যিকই বলি। একজন উপন্যাসিক যতোটা না কষ্টে ও সাধনার মধ্য দিয়ে একটি আস্ত বড়সড় উপন্যাস লিখে তার অধিক জ্ঞান ও সাধনার গভীরে গিয়ে আরেকজন সে উপন্যাসটি পড়ে, যিনি উপন্যাসটি লিখেন নি। পড়ার মধ্য দিয়ে সে ব্যক্তির যে জার্নি, জ্ঞান প্রেমাচল, বোধদয় হয় তা একজন লেখকের চেয়ে কম নয়, বরং এক ধাপ উপরেই। কারণ যিনি লিখে তিনি শুধুই লিখে কিন্তু যিনি পড়েন তিনি পড়ার ভেতর নিজের অনুভূতি ও বোধদয় একসাথে নতুন করে লিখে ও পড়ে! আপনাদের এমন স্বীকারোক্তি আশা থাকুক বা না থাকুক, আশাকরি বিষয়টি দুধ পানের মতো সহজ ভাবেই বুঝতে পেরেছেন।
এই সাহিত্যগোষ্ঠীর লোকদের একটা বড় দোষও আছে। বই পড়ার, বই কেনার প্রেম এদের যেমন সুন্দর তেমনি অসুন্দর সুন্দর বড় গুণও একটা আছে তাদের; তা হলো, বই ধার ও চুরি করে পড়া! বই ধার করা বা চুরি করে পড়া কোনো দোষের হতোনা, যদি তা ফেরত দেয়া হতো। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাবেন না যে, কারো বই ধার নিয়েছে পড়ার জন্য এবং তা সঠিক সময়ে আবার ফেরতও দিয়েছে। বাঙালিদের বই ধার দেয়া মানে আপনার কোনো সম্পত্তি তার নামে বিনা চুক্তিতে লিখে দিয়েছেন। অর্থাৎ এখানে কেউ কারো বই ধার নিলে তা ফেরৎ পাওয়া অসম্পূর্ণ এবং বিরল দৃষ্টান্ত! কেউ কেউ শুধু ধার নয় দেখাযায় - কোনো বই পড়ুয়া বন্ধুর বা পরিচিতের বাসায় এরা আড্ডা দিতে যাবে খালি ব্যাগে, আর ফিরবে দু'চারটে বই ব্যাগে করে নিয়ে। ঐ আড্ডার মাঝখানে যখন আপ্যায়নের নানান প্রস্তুতিগত সময়ে ব্যস্ত থাকে পরিচিত বন্ধু বা পরিচিতজন তখনই নিমন্ত্রণ পাওয়া ব্যাগশূন্য ভদ্র সুষ্ঠ চমৎকার পরিচিতজন কিংবা বন্ধুটা বইর তাক বা টেবিল থেকে দু'চারটে বই বাসে ঘুমরত যাত্রীর পকেট মারার মতো মেরে দেয়! তারা এটাই মানে, কারো বই মেরে দেয়া কোনো চুরিজনিত অপরাধ নয়। অর্থাৎ পৃথিবীর সব চুরিই চুরি হিসেবে সাবস্ত এবং অন্যায় হলেও বই চুরি করা কোনো চুরি বা অন্যায় নয়। সেকারণেই হয়তো পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত কোনো বন্ধু কোনো বন্ধুর বাড়ি থেকে এক আনা স্বর্ণচুরি করে সম্পর্কের কবর দিলেও, চোর খেতাব পেলেও কিংবা চোর হিসেবে বন্ধুর নিকট শাস্তি পেলেও কোনো বন্ধু কোনো বন্ধুর বাড়ি থেকে ডজনে ডজনে বই চুরি করেও কোনো সম্পর্ক ভাঙনের খবর, চোর খেতাব দেয়া কিংবা অপরাধী হিসেবে শাস্তি দিতে দেখা যায়নি। বই চুরি করে পড়া বা মেরে দেয়ার সুন্দর অপরাধ অধ্যায় আজ পর্যন্ত তাই কোনো আদালতেও যায়নি। একারণেই পৃথিবীর সমস্ত আদালতে পৌঁছায় সমস্ত মূর্খপাপ, কোনো বিদ্যাপাপ পৌঁছায় না হয়তো!
মুক্তগদ্যটি ইউটিউভে অডিও বুক হিসেবে শুনতে চাইলে ভিজিট করুন:
চ্যানেল লিংক
https://www.youtube.com/@leafoflife1
অডিও বুক লিংক: